×

অর্থনীতি

অস্থির বাজারে তিনটি পণ্য ঘিরে নতুন শঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৪১ এএম

অস্থির বাজারে তিনটি পণ্য ঘিরে নতুন শঙ্কা
অস্থির ভোগ্যপণ্যের বাজারে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে পেঁয়াজ। ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় দেশের বাজারে দাম বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় দেশটির নতুন সিদ্ধান্তে পেঁয়াজের বাজার আরো অস্থির হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একইভাবে চাল ও চিনিতে শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। নতুন করে অভ্যন্তরীণ মজুত ধরে রাখা ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার অজুহাতে সেদ্ধ চাল রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে দেশটি। এদিকে, ভারতের পর এবার চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারও। ভারত পেঁয়াজ, চাল চিনিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ কিংবা রপ্তানি নিরুৎসাহিত করার মতো যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে- তা এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার এবং এর জের ধরে বাংলাদেশের বাজারকে আরো অস্থির করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টরদের। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম সংকট হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এখন ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। এরমধ্যে ভারত ও মিয়ানমারের মতো দেশের এমন সিদ্ধান্তে বাজারে এসব পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, বাইরের দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি থাকলে সেসব দেশ অ্যাকশন নিলে কিছু করার থাকে না। এক্ষেত্রে সরকার ওইসব দেশের সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে পারে কোনো সুবিধা পাওয়া যায় কিনা। ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, ভারত তাদের নির্বাচনকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারকে অস্থির করে দিচ্ছে, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে। তিনি বলেন, ভারতের সিদ্ধান্তকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশে যারা এসব পণ্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে সেইসব সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেবে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেলে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ড. জাহিদ বলেন, যারা বাজারে সিন্ডিকেট বা কারসাজি করে তাদের সরকার চেনে। কিন্তু বলা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই। সরকার যেন অসহায়। তিনি বলেন, ঋণখেলাপিদের জন্য কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। উলটো ছাড় দেয়া হয়েছে। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা অজুহাতে তাদের প্রতি উদারতা দেখানো হয়েছে। ঋণখেলাপিদের নানাভাবে প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করে কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। পেঁয়াজে নতুন শুল্ক : জানা গেছে, ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানিকারকরা দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারকদের মোবাইল ফোনে নতুন শুল্কারোপের তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল শনিবার (২৬ আগস্ট) থেকেই নতুন এ শুল্কায়ন মূল্য কার্যকর হবে বলে জানা গেছে। এতদিন ১৫০/২০০ মার্কিন ডলার মূল্যে পেঁয়াজের এলসি খোলা হতো। সেই মূল্যের ওপর ৪০ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করেই পেঁয়াজ আমদানি করা হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারত নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। সেটি হলো- যে মূল্যেই এলসি করা হোক না কেন, ভারতীয় কাস্টমসে প্রতি টন পেঁয়াজের ৩২৫ মার্কিন ডলার শুল্কায়ন মূল্য ধরে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। ভারতের কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণী সংস্থা নতুন এই শুল্কায়ন মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর ফলে বর্তমানে পেঁয়াজের কেজি প্রতি যে প্রকারভেদে ৫-৭ টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হতো সেটি বেড়ে ১১ টাকার মতো পরিশোধ করতে হবে। এর আগে গত শনিবার (১৯ আগস্ট) ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি অমরিতা টিটুস স্বাক্ষরিত এক নোটিফিকেশনে জানানো হয়, ভারতে অস্বাভাবিকভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পেঁয়াজ রপ্তানির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এটা বহাল থাকবে। দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক হাজী মো. বাসেত ভোরের কাগজকে বলেন, শ্যামবাজারে গত এক সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দাম বাড়েনি। ভারত শুল্ক বাড়ালে দেশে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। বরং আমদানি বন্ধ করলে বিপদে পড়বে। তিনি বলেন, দেশের বাজারে পেঁয়াজের মাত্র ২০ শতাংশ মজুত থাকতে পারে। তাই দেশের পেঁয়াজের চাহিদা পূরণ করতে আমদানির উপরেই নির্ভর করতে হয়। চাল রপ্তানিতে নতুন শুল্ক : অভ্যন্তরীণ মজুত ধরে রাখা ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে সেদ্ধ চাল রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ভারত সরকার। গত ২৫ আগস্ট এ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয়, যা আগামী ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়। ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, রপ্তানির উদ্দেশে যেসব সেদ্ধ চাল ইতোমধ্যে শুল্কায়নের জন্য কোনো ভারতীয় বন্দরে রয়েছে এবং রপ্তানির জন্য ২৫ আগস্টের আগে বৈধ ঋণপত্র খোলা হয়েছে, সেসব চাল নতুন আরোপিত শুল্কের আওতার বাইরে থাকবে। সর্বশেষ এ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সব ধরনের অবাসমতী চাল রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করল ভারত। এর আগে গত ২১ জুলাই অবাসমতী সাদা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল দেশটি। ওই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য ছিল অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়ানো ও আসন্ন উৎসব মৌসুমের সময় চালের খুচরা দাম নিয়ন্ত্রণ করা। উল্লেখ্য, ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া চালের প্রায় ২৫ শতাংশ অবাসমতী সাদা চাল। তারও আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল ভারত।বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত। বিশ্ববাজারে ভারত যে পরিমাণ চাল রপ্তানি করে, তা রপ্তানি বাজারের ৪০ শতাংশের বেশি। ফলে তারা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় অন্য আমদানিকারক দেশে চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ বাড়তে পারে। বাংলাদেশও ভারত থেকে অবাসমতী সেদ্ধ চাল আমদানি করে। এদিকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক মিয়ানমার বছরে ২০ লাখ টনের বেশি চাল রপ্তানি করে থাকে বলে জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়। দেশটির রাইস ফেডারেশনের এক জ্যেষ্ঠ সদস্য রয়টার্সকে বলেছেন, এ মাসের শেষ থেকে ৪৫ দিনের জন্য চাল রপ্তানি আমরা সাময়িকভাবে সীমিত করতে চাই। অভ্যন্তরীণ বাজারের চালের দাম চড়তে থাকায় কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। এর আগে, বাসমতী নয়- এমন চাল রপ্তানিতে গত মাসে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক ভারত, তাতে বিশ্ব বাজারে চাল সরবরাহ কমেছে এক কোটি টন বা ২০ শতাংশ। দেশটির সরকারের তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ভারতের বাজারে বাসমতী নয় এমন সাদা চালের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম বাড়ানোর প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকার রপ্তানি নীতিতে পরিবর্তন এনেছে। চাল রপ্তানিতে ভারতের লাগাম টানার সিদ্ধান্তে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের মত শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশও পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও শুক্রবার ভারতের জয়পুরে অনুষ্ঠিত জি-২০ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মন্ত্রীদের সভার আগে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে বৈঠকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিত্যপণ্য সরবরাহের প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস জানিয়েছে, টিপু মুনশি সমপ্রতি পেঁয়াজের ওপর শতকরা ৪০ ভাগ রপ্তানি শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দামের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন ওই বৈঠকে। জবাবে ভারতীয় মন্ত্রী জানিয়েছেন প্রতিকূল আবহাওয়াসহ কিছু কারণে ভারতে উৎপাদন কম হয়েছে। সেজন্য তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে তিনি বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, দ্রুত ভারত এ সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। পেঁয়াজ ছাড়াও চালের রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়েছে ভারত। এছাড়া বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে চিনি রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে দেশটি, যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি। তবে পেঁয়াজ, চাল ও চিনির বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন ভারতীয় সিদ্ধান্তের প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে সহসা খুব একটা হবে না; কারণ এসব পণ্যের যথেষ্ট মজুত এখনো বাংলাদেশের আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App