×

অর্থনীতি

খেলাপি বাড়ে অন্যায্য সুবিধায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৩, ০১:০৩ এএম

খেলাপি বাড়ে অন্যায্য সুবিধায়

প্রতীকী ছবি

একযুগে খেলাপি বেড়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি, আইন থাকলেও প্রয়োগের অভাব

বাংলাদেশে গত ১৪ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ছয়গুণেরও বেশি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের আকার প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা থাকলেও চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ছোট্ট এই পরিসংখ্যানই ব্যাংকিং খাতের নড়বড়ে অবস্থার চিত্র স্পষ্ট করে দেয়। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের ক্ষেত্রে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে তার মধ্যে আছে- খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন, ঋণ খেলাপির সংজ্ঞায় পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ২১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে আনা প্রভৃতি। অনেক দেশ আইনের শক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ অনেক কমিয়ে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনোভাবেই পারছে না। সহজ করে বলা যায়, গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে যত বেশি সুবিধা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা; ঠিক তত বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশে আইনের দুর্বলতা রয়েছে। আবার দুর্বল আইন থাকলেও এসব প্রয়োগের অভাব রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ব্যাংকিং খাতেও খেলাপিদের বিরুদ্ধে কখনোই খুব কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি; বরং তারা বারবার নানা রকমের সুবিধা পেয়েছেন।

জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে প্রভাবশালীদের বেশি সুবিধা দেয়া হয়েছে মূলত ২০০৯ সালের পর থেকে। তাদের চাপে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়, ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা, ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে দেয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ঋণের দুই শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত রাখার সুযোগ করে দেয়া হয়। সেই নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেয়া হয়, যার প্রথম বছরে কোনো কিস্তি দিতে হবে না। কিন্তু খেলাপি ঋণ কমার বদলে আরো বেড়েছে। খেলাপি ঋণ ঠেকাতে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককেও কখনো খুব কঠোর অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। এরকম অনিয়মে ঋণ বিতরণের সীমা টেনে দেয়া, নতুন শাখা খোলা বন্ধ, পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া বা পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো ক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু ঋণ নিয়ে বড় বড় অনিয়মের পরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একপ্রকার নীরব থাকতে দেখা যায়। এসব সুবিধার অপব্যবহারের কারণে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের আকার প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা থাকলেও চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ছিল এটি, যা ওই সময় মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরের শেষে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং মার্চ শেষে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় একটি ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। এ ব্যাধি সারাতে হলে সরকারের সদিচ্ছা দরকার। তিনি বলেন, যারা বড় বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হয়েছেন, তাদের কখনো শাস্তি হয়েছে বলে আমি শুনিনি। যেসব ব্যাংক এর সঙ্গে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ ব্যাংককে খুব কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়ে কারো মধ্যে কোনো ভয় থাকে না। তিনি বলেন, সমস্যাটা হলো কিছু ভুল নীতি এবং সেটা ঠিক না করেই ব্যবস্থা নেয়া। এটা আসলে লিগ্যাসি প্রবলেম- আপনি কিছুদিন পরপর ঋণখেলাপিদের ছাড় দিচ্ছেন। এটা আসলে তাদের একটা ব্যাড সিগন্যাল দিচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে দিনের পর দিন ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয় না।

জানা যায়, ২০১৯ সালে শীর্ষ ৩০০ খেলাপির তালিকা সংসদে প্রকাশ করা হয়। সংসদে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানিয়েছিলেন, তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকা সংসদে প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক কোভিড মহামারি ও পরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সময়েও বিশেষ ছাড় দিয়েছিল। ঋণের ২ দশমিক ৫ থেকে চার শতাংশ ব্যাংকে জমা দিয়ে নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। আগে এ হার ছিল ১০ শতাংশ। তারপরও খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েছে। ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাদায়ী ঋণের একটি বড় কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই না করেই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে বড় আকারে ঋণ অনুমোদন দেয়া। তবে বিশ্বের অনেক দেশে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে সংকটময় পরিস্থিতি থেকেও ব্যাংকিং খাতকে তুলে আনা হয়েছে। চীন ও ভিয়েতনামে ঋণখেলাপি ও অর্থ আত্মসাতকারীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ঋণখেলাপি হলে তারা বিমান বা রেলের টিকেট কিনতে পারেন না, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না। সিঙ্গাপুরে ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে। একই রকম আইন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়। সে দেশে ঋণ পরিশোধে দেউলিয়া ঘোষিত হলে তিনি আর কোনো আর্থিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারেন না বা বাড়ি কিনতে পারেন না, সম্পদের মালিকও হতে পারেন না। এরকম অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সমস্ত সম্পদ জব্দ করা হয়। তিনি ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত আর কোনো সম্পদের মালিক হতে পারবেন না। দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা খেলাপি ঋণ অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়। এসব ঋণ অনেক সময় শেয়ারে রূপান্তর করার মাধ্যমে কোম্পানির মালিকানায় পরিবর্তন আনা হয়। তবে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আদায়ে যে আইন রয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সেই আইনেও বড় কোনো ঋণখেলাপির শাস্তির নজির নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং দেউলিয়া আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। পাওনা ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক কোম্পানি আইনে ব্যাংকের ওপর নজরদারি বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর দেনা পরিশোধে অসমর্থ হলে দেউলিয়া ঘোষিত হতে পারে। যমুনা ব্যংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন, উচ্চ আদালতে রিটের মাধ্যমেও অনেক খেলাপি ঋণ হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। রি-শিডিউল করা ঋণ হিসাবে রাখা হয় না। আরো অনেক কৌশল আছে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর। তাই বাস্তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। এর বড় একটি অংশ আর কখনোই ফেরত পাওয়া যাবে না।

পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রভাবশালী ঋণখেলাপিরা সবসময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছে। কখনো উচ্চ আদালতে গিয়ে ঋণখেলাপির বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখছে বছরের পর বছর। এভাবে প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের শাস্তি দিতে না পারা খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, অর্থঋণ আদালতেই খেলাপি ঋণের অভিযোগে বর্তমানে ৭২ হাজার মামলা ঝুলে রয়েছে, যেখানে আটকে রয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। আইন অনুযায়ী, ঋণখেলাপি ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু মাত্র দুই শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, এরকম পুনঃতফসিলের সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর আবার তারা ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, ওই ঋণ আদায় হয়নি। খেলাপি ঋণ আদায়ে ২০১৯ সালে ‘অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশের সরকার। যেখানে খেলাপি ঋণের জন্য পৃথক আদালত তৈরি করা, খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের হালনাগাদ তথ্য নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করার মতো প্রস্তাবনা ছিল, যদিও তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

এদিকে চলতি বছর ২১ জুন জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সংজ্ঞায়িত করে নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন পাস হয়েছে। আইন অনুযায়ী, ঋণ শোধ করছেন না এমন গ্রাহকদের মধ্যে যারা সামর্থ্য থাকার পরও শোধ করবেন না এবং যারা জালিয়াতি, মিথ্যা তথ্য ও প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ নেবেন, তারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এছাড়া এক উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়ে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে এবং ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া জামানত হস্তান্তর করলেও ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App