×

অর্থনীতি

চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সংস্কার জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৩, ০৮:১৭ এএম

চ্যালেঞ্জ উত্তরণে সংস্কার জরুরি

ছবি: সংগৃহীত

ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি- দেশের অর্থনীতিতে এ তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি মনে করছে- এসব কারণে দেশের প্রবৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রার মজুত ও স্থানীয় মুদ্রা টাকার ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে। এ চ্যালেঞ্জ তিনটির সঙ্গে আগামী নির্বাচনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদরা জানান, চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে হলে অর্থনীতিতে সংস্কার জরুরি। নির্বাচনকে আরো ঘনিয়ে আসার আগেই দেশের অর্থনীতির সংস্কার, কাঠামোগত পরিবর্তন এবং বর্তমান প্রবাহ ধরে রেখে সামষ্টিক অর্থনীতির দিকটা ঠিক করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট চলছে, সেটার জন্য মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করতে হবে। এটা করলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা নয়। সমস্যা কিছুটা কমবে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়ানো সহজ হবে। আর্থিক খাতের যে মৌলিক সমস্যা রয়েছে সেটাকে আগে স্বীকৃতি দিতে হবে। তিনি বলেন, আইএমএফ যে বিষয়টি চিহ্নিত করেছে- আর্থিক খাতের দুর্দশাগ্রস্ত সংকটের হিসাব করে তা প্রকাশ করতে হবে।

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদিত ব্যাংকিং কোম্পানি আইন পার্লামেন্টে পাশ করে বাস্তবায়নের পথে যেতে হবে। ড. জাহিদ বলেন, সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আগামী বছরের মধ্যে ১০ শতাংশে নিয়ে আসার যে লক্ষ্যমাত্রা আইএমএফ দিয়েছে, সে বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজস্ব খাত নিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায় এক বড় সমস্যা। রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার কী কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে, সেটা স্পষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, কর সুবিধার কারণে রাজস্বের যে ক্ষতি হয়- তা বন্ধে সরকার কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে তাও জানা দরকার।

করোনা মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতিতে নতুন করে আঘাত হানে বৈশ্বিক অস্থিরতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দেশের অর্থনীতি। বিশ্বজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ডলারের মূল্যমানে তারতম্য দেখা দিয়েছে। ফলে প্রায় এক বছর আগে ৮৫ টাকার ডলার এখন বিক্রি হচ্ছে ১০৮ থেকে ১১০ টাকায়। খোলা বাজারে তা আরো বেশি। ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতিতে কমে এসেছে আমদানির হার, লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলাতে জারি করা হয়েছে কড়াকড়ি শর্ত। এতে কাঁচামাল আমদানির পরিমাণ কমে আসায় পণ্য উৎপাদনও কমেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে, বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, কমেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। অর্থনীতির আয়ের মূল চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স-রপ্তানিতেও ভাটার টান। এছাড়া প্রতিনিয়ত বাড়ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেলের দাম। বাড়তি দামের প্রভাবে কমতে পারে পণ্য উৎপাদন। চাহিদার তুলনায় জোগান না হলে পণ্যদ্রব্যের দাম ফের বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে আরো কয়েক শতাংশ। সবমিলিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছে ১৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। পাশাপাশি গত বছরের এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছিল ২০১ কোটি ডলার। ফলে গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় এ বছর এপ্রিলে প্রবাসী আয় কমেছে ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। তাছাড়া গত মার্চ মাসে বৈধপথে ২০২ কোটি ২৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। সেই হিসাবে এপ্রিলে রেমিট্যান্স কমেছে ৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এদিকে অর্থনীতির আরেক চালিকাশক্তি রপ্তানি আয় কয়েক মাস ইতিবাচক সাড়া ফেললেও গত দুই মাস পতনে ডুবেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সূত্র মতে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আয় হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার; যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৮ কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার বা ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। এদিকে আগের বছরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমার পাশাপাশি চলতি বছর এপ্রিল মাসের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি সরকারের। রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫০৫ কোটি ডলার। একই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৯৫৬ মিলিয়ন বা ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ ইউএস ডলার সমপরিমাণ পণ্য। হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম আয় হয়েছে। ফলে ফেব্রুয়ারি মাসে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর মার্চ ও এপ্রিল টানা দুই মাস বিশ্ববাজারে কমেছে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয়।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের রিজার্ভ সমস্যা আছে, ডলার সংকট আছে, মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছ, কাক্সিক্ষত রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। তাই আইএমএফের কথা অনুযায়ী তাদের সংস্কার বা শর্তগুলো বাস্তবায়ন করলে তা আমাদের জন্যই ভালো হবে। তবে আইএমএফ যেসব চ্যালেঞ্জের কথা চিহ্নিত করেছে তা এমনি এমনি দূর হবে না। এজন্য নীতি গ্রহণ করতে হবে।

তিনি বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার এনবিআরের ভেতর থেকে সম্ভব নয়। এটা একেবারে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে, কঠোর দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে। সরকারের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তবে বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে প্রতিবারই দেশে অনিশ্চয়তার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, পাশাপাশি অর্থপাচারের ব্যাপারটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এমনাবস্থায় আমাদের রেমিট্যান্স খুব একটা বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে না। উল্টো অর্থপাচারের দোলাচলের মাঝে আমাদের অর্থনীতির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে। ড. মনসুর বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরির আগেই দেশের অর্থনীতির সংস্কার, কাঠামোগত পরিবর্তন এবং বর্তমান প্রবাহ ধরে রেখে সামষ্টিক অর্থনীতির দিক ঠিক করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

কমছে রিজার্ভ : রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভের উপর বেশ প্রভাব পড়েছে। তাতে দেশে অতিমাত্রায় ডলার সংকট দেখা দেয়ায় আমদানি ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়ে রিজার্ভ থেকে খরচ করছে সরকার। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমে আসছে। বর্তমানে দেশের রিজার্ভের মোট পরিমাণ ৩০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাছাড়া গতকাল সোমবার ১ দশমিক ১৮ বিলিয়নের বেশি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধ করার কথা ছিল। এর ফলে রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। আকু বিল পরিশোধের পর রিজার্ভের পরিমাণ হয় ২৯ বিলিয়ন ডলার।

তাছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যদি রিজার্ভ হিসাব করা হয়, তাহলে এ অঙ্ক আরো কমে আসবে। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ নেমে দাঁড়াবে ২২ বিলিয়ন ডলারে। প্রতি মাসে ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ ধরা হলে তাতে এ রিজার্ভ দিয়ে মাত্র সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ। এদিকে আইএমএফকে দেয়া প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের মধ্যে ব্যবধান দুই টাকায় নামিয়ে আনার চিন্তা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসাবে বিবেচিত। ফলে জুনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১০৬ টাকায় নির্ধারণ করতে পারে। তাছাড়া নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রতি ডলারে দাম ১০৭ টাকার পরিবর্তে ১০৮ টাকা পাবেন। একইভাবে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পাবেন ১০৬ টাকা, যা বর্তমানে ১০৫ টাকা রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি ৯ এর ঘরে : বর্তমানে বিশ্বের পণ্য আমদানি-রপ্তানির একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ডলার। তাই সুযোগ বুঝে দফায় দফায় সুদহার বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বেড়েছে পণ্যের দাম, মূল্যস্ফীতির পরিমাণ। চলমান এ যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল এবং অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ায় বাংলাদেশেও রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে চলমান মূল্যস্ফীতি এপ্রিল মাস শেষে এখনো ৯ শতাংশে অবস্থান করছে। অর্থাৎ একটি ১০০ টাকার পণ্য বা সেবা ক্রয় করতে এখনো মানুষকে ১০৯ টাকা বা তার বেশি ব্যয় করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, টানা পাঁচ মাস কমার পর ফেব্রুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে। মার্চ মাসে আবারো সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয় ৯ দমমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিল মাসে কিছুটা কমে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া এপ্রিলে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ, গত মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App