×

অর্থনীতি

খেলাপি ঋণে অনিয়ম আইএমএফের উদ্বেগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৪৩ এএম

বাজেট সহায়তায় আইএমএফের সংস্কার মেনেই ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা সফররত আইএমএফের প্রতিনিধি দল। খেলাপি ঋণ আদায়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে তারা। এছাড়া ব্যাংক খাতে যেসব অনিয়ম হচ্ছে, তা শাস্তির আওতায় আনতে পারছে কিনা- সে প্রশ্নও তুলেছে বৈশ্বিক সংস্থাটি। বাংলাদেশ ব্যাংক তার উত্তরে জানিয়েছে, বিআরপিডি মাস্টার সার্কুলার ১৬ অনুযায়ী খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রসঙ্গত বিআরপিডি ১৬ সার্কুলারে ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণে আরো বেশি ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমান গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার যোগদানের এক সপ্তাহ পর এই সার্কুলার জারি করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারেই বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে কিছু কিছু বিষয়ে সরকার সরাসরি যুক্ত থাকায় ওইসব সিদ্ধান্তে সরকার হস্তক্ষেপ করে। দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে গতকাল রবিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে তা সঠিক ব্যবহার না হলে দেশে সংকট আরো বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মুদ্রানীতিবিষয়ক বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। তারা বছরে চারবার মুদ্রানীতি প্রণয়নের পরামর্শ দেয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বছরে চারবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন সম্ভব নয়। কেননা মুদ্রানীতিতে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সূচক বছরে একবার বা দুবারই প্রকাশ করে থাকে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকও এখন থেকে বছরে দুবার মুদ্রানীতি প্রণয়ন করবে বলে আইএমএফকে জানানো হয়েছে।

ঋণের শর্ত নিয়ে ইতোমধ্যে ঢাকায় আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শেষে পরামর্শগুলো মেনে নেয়ার আভাস দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্ধারণে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ, ব্যাংকের সুদ হারের সীমা প্রত্যাহার, বৈদেশিক মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার, খেলাপি ঋণ কমানো ও সংজ্ঞা পরিবর্তন এবং জ¦লানি তেলের ভর্তুকি কমানো। এর বাইরে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কার, কর ব্যবস্থাপনাকে দক্ষ করে কর আদায় বাড়ানো অন্যতম। সরকার আইএমএফের কাছে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সফর করছে। তারই অংশ হিসেবে গতকাল আইএমএফের বাংলাদেশ মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও প্রধান অর্থনীতিবিদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের মতো বৈঠক করে। আগামী ৩১ অক্টোবর, ২ ও ৮ নভেম্বর আবারো বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠক হবে।

বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জী এম আবুল কালাম আজাদ ভোরের কাগজকে বলেন, আগের দিনের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আজও আইএমএফের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে।

আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আলোচনা আরো কয়েকদিন চলবে। তিনি বলেন, এক্সটেন্ডেন্ট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি, র‌্যাপিড ফাইন্যান্সিং ইনস্ট্রুমেন্ট ও র‌্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি- এই তিনটি স্কিমের আওতায় দেড় বিলিয়ন করে মোট সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চাওয়া হয়েছে আইএমেএফের কাছে। ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদী। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

সংস্কার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, সংস্কার হচ্ছে বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। যা অর্থমন্ত্রী আগেই প্রস্তাব রেখেছিলেন। তার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক এই সংস্কারকাজ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির উন্নতি আগেই করা উচিত ছিল উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সিরডাপের পরিচালক (গবেষণা) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন বলেন, অতীতে ঋণের অর্থ উন্নয়ন প্রকল্পসহ নানা খাতে প্রকৃত খরচের চেয়ে শতকরা ৩০ ভাগ বেশি খরচ করা হয়েছে। তিনি বলেন, সামনে মন্দা বা দুর্ভিক্ষের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের তো মানুষকে তার ফান্ড থেকে খাওয়ানোর সক্ষমতা নেই। তাই সরকারকে এবার ঋণ সঠিকভাবে খরচ করতে হবে। মিতব্যয়ী হতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আইএমএফ হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সংকট মোকাবিলায় আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আইএমএফ যে হিসাব পদ্ধতি বলছে সেটিও ঠিক আছে। ঋণ পাওয়ার জন্য তাদের হিসেব মতোই রিজার্ভের হিসাব করা হবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রিজার্ভের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর বলে আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা শুরু হতে একটু সময় লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সাপেক্ষে পাস করাতে হবে। এছাড়া সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে কবে নাগাদ শুরু করা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি শুরুতে বিদ্যমান পদ্ধতির হিসাবও প্রকাশ করা হবে। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা রিজার্ভের অর্থ বাদ দিলে (রিজার্ভ) প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে।

ডলার সংকটে ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলারে। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ উঠেছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থ ডলারের পাশাপাশি বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ করে রেখেছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ রাখা হয়েছে ডলারে। আবার রিজার্ভের অর্থে দেশেও তহবিল গঠন করা হয়েছে।

রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)। এছাড়া রিজার্ভের অর্থে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। এছাড়া উড়োজাহাজ কিনতে বাংলাদেশ বিমান ও সোনালী ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে অর্থ দেয়া হয়েছে। পায়রাবন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ খরচ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন তহবিল ও প্রকল্পে রিজার্ভের আট বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে। এর বাইরে শ্রীলঙ্কাকে দেয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফ যে হিসাব পদ্ধতির কথা বলছে তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা। রিজার্ভকে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে আমাদের মাপতে হবে। আমরা এতদিন সেটি করিনি। এখন আইএমএফ যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে করা উচিত। তিনি বলেন, সব সম্পদ রিজার্ভের সম্পদ নয়। এ সংশোধনটি দরকার ছিল। আইএমএফের যেভাবে রিজার্ভের হিসাব চাচ্ছে যেভাবে করে নেয়া উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App