×

অর্থনীতি

মন্দা ঠেকাতে খাদ্য নিরাপত্তায় জোর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৪৫ এএম

মন্দা ঠেকাতে খাদ্য নিরাপত্তায় জোর

প্রতীকী ছবি

বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বলছে, বিশ্ব ‘মন্দার দ্বারপ্রান্তে’। এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো মন্দার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলন (আঙ্কটাড) গত সোমবার বলেছে, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি, সুদের হার বাড়ানোসহ নানা কারণ বিশ্বকে একটি বৈশ্বিক মন্দা ও স্থবিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক কয়েক মাস ধরেই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে। সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনেও গুরুত্ব পেয়েছে এ প্রসঙ্গ। তিনিও এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই বছরের করোনা মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরেই বিশ্বে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের সামনে কয়েকটি বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসবে। আর তাই মন্দা মোকাবিলায় খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, ১৯৭০ সালের মন্দার পর বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে সংকটে রয়েছে। আগের মন্দা শুরুর আগে মানুষের ব্যয়ের যে প্রবণতা ছিল, সে তুলনায় বর্তমানে মানুষ অনেক কম খরচ করছে। অর্থাৎ কমে গেছে ভোক্তার আস্থা।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন চাপে আছে। মন্দার প্রভাবে আমরা ক্রমান্বয়ে ‘সবুজ’ থেকে ‘হলুদে’ চলে যাচ্ছি। তাই এখনই সময়, অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলা এবং আমদানি প্রতিস্থাপন করার ব্যবস্থা করা।

তিনি বলেন, অস্থিতিশীল ভাগ্যলক্ষ্মী থেকে স্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ বাজারে বেশি মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোক্তাদের আরো বেশি করে প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে এসব উদ্যোক্তারা দেশীয় কাঁচামালের ভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন করে অভ্যন্তরীণ বাজারে দিতে পারে। এক্ষেত্রে কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তাহলে খাদ্য নিরাপত্তায়ও মনোযোগ দেয়া হবে।

অবশ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক অর্থনীতির এ হালের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ আর পরাশক্তিগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞাকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের মানুষকে প্রতি ইঞ্চি জমিতে শস্য আবাদের পরামর্শ দিয়েছেন যাতে করে উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষ সঞ্চয় করতে পারে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে ঢাকায় ফিরে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যানুষ্ঠান ও জাতিসংঘের অধিবেশনের সময় বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে জানান, তারা বিশ্বময় একটি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন এবং ২০২৩ সালে দুর্যোগময় সময় ঘনিয়ে আসছে বলে মনে করেন। তবে তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশের এই মুহূর্তে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো যা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। কিন্তু বিশ্ব যদি সমস্যায় থাকে সেক্ষেত্রে আমরা কি ভালো থাকব এজন্য মানুষের কষ্ট লাঘবে যা করা দরকার তার সব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আগামী বাজেট নিয়েও এখনই চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে আমেরিকা ও রাশিয়ার নানা পদক্ষেপের কারণে ইতোমধ্যেই অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং দ্রব্যমূল্য বেড়েছে অনেকখানি। সামনে সংকট আরো বেশি হলে অর্থনীতির অবস্থা কেমন দাঁড়ায় তা নিয়ে তাই বেশ উদ্বেগ আছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিলাসদ্রব্য আমদানি সীমিত করেছে ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমিয়ে এনেছে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, ইতোমধ্যে রপ্তানিতে মন্দার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি আদেশ দুটোই কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখনো মন্দা আসেনি। সেখানে যদি মন্দা চলে আসে, তবে তার একটি প্রভাব আমাদের দেশেও পড়বে। শুধু পোশাক নয়, পোশাক বহির্ভূত অন্য খাতেও এর প্রভাব পড়বে। কারণ মন্দার সময় মানুষ খাদ্যকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।

তিনি বলেন, আর্থিক খাতেও ইতোমধ্যে মন্দার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের ব্যাংকার, আমদানিকারক, রপ্তানিকারকরা স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে থাকেন এলসি নিষ্পত্তির জন্য। সারাবিশ্বে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় এগুলোর সুদের হারও বেড়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ সুদের হার কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে যে স্বল্পমেয়াদে ঋণ নেয়া হয়, সেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সব খরচ মিলে সাড়ে ৩ শতাংশের একটি ক্যাপ বসিয়ে দিয়েছে। এর ফলে ঋণ পাওয়া আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এজন্য আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থায়নে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই রপ্তানি আদেশ কম, আমদানিতে ডলার সংকট, অব্যবস্থাপনার কারণে প্রবাসী আয় কম আসছে। সেক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতি চলমান রাখতে হলে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

সংকট মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রধানত খাদ্য নিরাপত্তা এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। চলতি বছর প্রকৃতি আমাদের কৃষির ওপর সদয় হয়নি। তাই আগামীতে আমনের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এজন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। যদিও সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোর অগ্রগতির দিকে নজর রাখতে হবে। খাদ্য মজুত নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্তদের সহযোগিতা আরো বাড়াতে হবে। ফ্যামিলি কার্ড চালু হয়েছে। এর পরিধি আরো বাড়াতে হবে। পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তায় গুরুত্ব দিতে হবে। এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন ঠিকমতো করতে না পারলে শিল্প উৎপাদন পরিস্থিতি আরো খারাপ অবস্থায় যাবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, কৃষি আর রেমিট্যান্সে প্রণোদনাসহ আনুষাঙ্গিক পদক্ষেপ ঠিকমতো নিতে পারলে মন্দার চাপ মোকাবিলা করা সহজ হবে। একইসঙ্গে চলতি বছর ডলার সংকট মোকাবিলায় যেভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে সে ধরনের পদক্ষেপ নেয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্ব মন্দা হলে রপ্তানির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জ্বালানি তেলের দাম হয়তো কিছু কমবে, বিশ্ববাজারে পণ্যের দামও কমবে, যা বাংলাদেশের জন্য ভালো দিক। তবে বৈশ্বিক সুদহার বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বা বিদেশি পুঁজি ব্যয়বহুল হবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাবে। আমরা জানি, আমাদের বেসরকারি খাতের ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ রয়েছে। এক্ষেত্রেও সুদহার এবং খরচও বেড়ে যাবে। আর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা দুটি জায়গায় পিছিয়ে ছিলাম। যেমন বিনিময় হার ও সুদহার বাড়ানো। এর মধ্যে বিনিময় হারে অবমূল্যায়ন ঘটছে। কিন্তু অন্য দেশ পারলেও আমাদের সুদহার বাড়ানো যাচ্ছে না। এটা একটা সমস্যা।

বিশ্বমন্দা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর শঙ্কার আভাস: বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলন (আঙ্কটাড) গত সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে যে, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট এবং ২০২০ সালে করোনা মহামারি সংকট এবার আরো ঘনীভূত হতে পারে।

এতে আরো বলা হয়েছে, সব অঞ্চল প্রভাবিত হবে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদের ঘণ্টা বাজছে, যার মধ্যে অনেকগুলো ঋণখেলাপির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ বছরের সুদের হার বাড়ানো চীন ব্যতীত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আনুমানিক ৩৬০ বিলিয়ন ডলার আয় হ্রাস করবে বলেও জানায় সংস্থাটি।

আঙ্কটাডের মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের সতর্ক করা দরকার যে, আমরা একটি নীতি-প্ররোচিত বৈশ্বিক মন্দার দ্বারপ্রান্তে। আমাদের এখনো মন্দার প্রান্ত থেকে ফিরে আসার সময় আছে। কিছুই অনিবার্য নয়। আমাদের অবশ্যই পথ পরিবর্তন করতে হবে।

আঙ্কটাড বলছে, পূর্ব এশিয়ায় এবার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে যা গত বছর ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ব্যয়বহুল আমদানি ও রপ্তানির জন্য বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাসের পাশাপাশি চীনের মন্দাও এই অঞ্চলে আরো চাপ বাড়াবে। দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় ঋণ সংকট বাড়ছে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কা খেলাপির মধ্যে পড়েছে। আফগানিস্তানে ঋণের সংকটে রয়েছে এবং তুরস্ক ও পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। পাকিস্তান বন্যার কবলে পড়েছে, এবং ঋণ বাড়ছে ও বৈদেশিক রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে।

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন থেকে বিশ্বব্যাংক তার ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুত গতি হারাচ্ছে। ফলে আগামী বছরে সামান্য আঘাতেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে যে আশঙ্কা করেছে সেটি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক এ সংস্থাটি বলছে, সম্ভাব্য এই মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংকের শঙ্কা, একে তো চলছে অর্থনৈতিক সংকট, তারপর সুদের হার বৃদ্ধির এই পরিমাণ ২০২৩ সালে বিশ্বে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে বা শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ মাথাপিছু আয় সংকোচন করতে পারে। এমন পরিস্থিতিকেই সংজ্ঞাগতভাবে বৈশ্বিক মন্দা বলা হয়ে থাকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App