×

অপরাধ

কারা এই জঙ্গি ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২৫ এএম

কারা এই জঙ্গি ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’
  • কুলাউড়ার পাহাড়ি এলাকায় অভিযান, কয়েকজন আটক
একেবারেই নতুন নামের নতুন ধরনের একটি জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ পেয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামের এই সংগঠনের নাম বা কাজের ধরনের সঙ্গে কখনো পরিচিত ছিল না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নতুন জঙ্গি সংগঠন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার টাট্টিউলি গ্রামে জমি কিনে আস্তানা তৈরি করেছিল। যা ভারত সীমান্ত থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। গতকাল শনিবার ভোরে প্রায় ৪ ঘণ্টার অভিযান শেষে জঙ্গি আস্তানা থেকে নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আটককৃতদের মধ্যে ৩ শিশু, ৬ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ রয়েছে। এই সংগঠনের প্রধানের খোঁজ পাওয়া গেলেও তিনি অধরা। তাকে ধরতে অভিযান চলছে। ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র কার্যক্রম খতিয়ে দেখছেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা। গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশের কাছে দাবি করছে, তারা বিশ্বাস করে ‘হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত- রসূল (সা:) বলেছেন, অচিরেই হিন্দুস্থানের মুশরিকরা মুসলমিদের প্রতি নির্যাতন বৃদ্ধি করবে। সে সময়ে হিন্দুস্থানের পূর্ব অঞ্চল থেকে একটি মুসলিম জামাতের প্রকাশ ঘটবে। যার নেতৃত্বে থাকবনে মাহমুদ, উপাধি নাম হবে হাবীবুল্লাহ। তার পিতার নাম আব্দুল কদির ও মাতার নাম সাহারা হবে। তিনি দেখতে খুবই দুর্বল হবেন। তার মাধ্যমে আল্লাহ হিন্দুস্থানের মুসলিমদের বিজয় দান করবেন। তিনি হিন্দুস্থান বিজয়ের পর কাবার দিকে ধাবিত হবেন।’- এই বিশ্বাস থেকে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে সংগঠন গড়ে উঠলেও তাদের কার্যক্রমের পরতে পরতে আছে জঙ্গিবাদের ধরন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ মাথায় নিয়ে ধর্মীয় আবেদন তৈরি করতেই জঙ্গি বা সন্ত্রাসী দল একটি মতাদর্শকে বেছে নেয়। এর পেছনে মূলত উদ্দেশ থাকে সহিংসতার। এখানে মতাদর্শের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করা। যেহেতু দেশে সামনে একটি নির্বাচন রয়েছে ও দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। সেক্ষেত্রে যারা দেশের শান্তি বিনষ্ট করতে চায়- তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়ও নতুন এমন দল আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে থাকতে পারে। সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান গতকাল জানান, ‘অপারেশন হিলসাইড’ নামে অভিযানে জঙ্গি সংগঠনকে অংকুরেই নস্যাৎ করা হয়েছে। তাদের কাছে তথ্য ছিল ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের। তারা কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামের দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলে। এই সংগঠনের প্রধানের নামও নিশ্চিত হওয়া গেছে। মাত্র ৭ দিন আগে তারা দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করে। এখান থেকে নারী-শিশুসহ মোট ১৩ জনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের কাছ থেকে ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা ও স্বর্ণালংকার, ৫০টি ডেটোনেটর, আড়াই কেজি বিস্ফোরক, প্রশিক্ষণসামগ্রী ও বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি জানান, অভিযান পরিচালনার পর কেউ পালিয়ে যেতে পারেনি। এখানে যারা আসা-যাওয়া করত তাদের নামের তালিকা আছে। তিনি বলেন, এই উগ্রবাদী সংগঠনের মূল ব্যক্তিকে ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। সংগঠনের এক সদস্যকে স¤প্রতি ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ব্যক্তির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কুলাউরার পূর্ব টাট্রিউলি এলাকায় অভিযান চালানো হয়। মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মনজুর রহমান বলেছেন, এরা হোমগ্রুন জঙ্গি। ইমাম মাহমুদ নামে একজনের অনুসারী। যার আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটবে এবং ইসলামী শাসন কায়েম হবে- এমন ভাবনা থেকে তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের একাধিক গ্রুপ আছে। সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় আস্তানা গাড়লেও ভারতে তাদের যোগাযোগ ছিল কিনা- খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জানা গেছে, একেবারেই নতুন নামের এই উগ্রবাদী সংগঠনে নারী-পুরুষরা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে আস্তনায় ছিল। মগজ ধোলাই করে দাওয়াতি কার্যক্রমের নামে তারা লোকজনকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে। ঢাকায় সন্দেভাজন এক ব্যক্তিকে আটক হলে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এই সংগঠন সম্পর্কে তথ্য দেন। সিটিটিসি এ নিয়ে খোঁজখবর করে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা এই জঙ্গি সংগঠনের ব্যাপারে জানতে পারে। এর পর শনিবার চলে অভিযান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে জঙ্গি নিয়ে কাজ করে- এমন একটি বিশেষায়িত ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, কুলাউরায় ধৃতদের মধ্যে অনেকে মেহেরপুর শহরের শিশু বাগান পাড়া এলাকায় থাকত। ৩ আগস্ট থেকে তারা নিজেদের আড়াল করে রাখে। এর মধ্যে শনিবার ধরা পড়েছে সিসিটিসির কাছে। কুলউড়ার স্থানীয় বাসিন্দা ইয়াকুব আলী সাংবাদিকদের জানান, ভারতীয় সীমান্ত থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়েছে। যুগিটিলা এলাকার বাসিন্দা শামসুল মিয়া জানান, অজ্ঞাত কিছু লোক ওই এলাকায় বসবাস শুরু করে। তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে তেমন কথা বলত না। তবে আস্তানায় একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে দেখা যেত, যে কিনা জুগিটিলা বাজারে গিয়ে প্রায়ই কেনাকাটা করত। তবে অভিযানের সময় ওই ব্যক্তিকে দেখা যায়নি। এর আগে গত ৩ আগস্ট মেহেরপুরে অভিযান চালিয়ে ১৮ জনকে তাদের বাড়ি থেকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৮ আগস্ট পাঁচ শিশুকে তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের কাছে ফেরত দেয়া হয়। মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহসিন জানান, গ্রেপ্তারদের সিটিটিসি ঢাকায় নিয়ে গেছে। এদিকে মেহেরপুরের পুলিশ সুপার রাফিউল আলম জানান, মেহেরপুরে কেউ নিখোঁজ হয়নি; তবে সিটিটিসি মামলা করার পর কয়েকজনকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আমাদের কুলাউরা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ‘অপারেশন হিলসাইডে’ আটক ১৩ ‘জঙ্গির’ মধ্যে মা- মেয়েসহ তিনজনের বাড়ি সাতক্ষীরার তালা উপজেলায়। ‘জঙ্গি আস্তানা’য় ওই তিনজন রহস্যজনকভাবে যাতায়াত করতেন। আটক ওই তিনজন হলেন- তালা উপজেলার দক্ষিণ নলতা গ্রামের ওমর আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম, শফিকুল ইসলামের স্ত্রী আমেনা বেগম ও তার মেয়ে হাবিবা। এলাকাবাসী জানান, ‘অপারেশন হিলসাইডে’ আটক ওই তিনজনের ‘জঙ্গি আস্তানায়’ আসা যাওয়া ছিল রহস্যজনক। তারা মাঝেমধ্যেই ওই বাড়িতে যেতেন, আবার দ্রুত ফিরেও আসতেন। তারা ঢাকা বা তার আশপাশে কাজ করেন। স্থানীয়রা আরো জানান, শরিফুল ইসলামের আগেও একবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে তারা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কিনা তা স্থানীয়রা বলতে পারেননি। তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চৌধুরী রেজাউল ইসলাম জানান, শনিবার কুলাউড়ায় জঙ্গি আস্তানা থেকে সাড়ে ছয় ঘণ্টার অভিযানে ছয় নারীসহ ১৩ জঙ্গি সদস্যকে আটক করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এই অভিযানে আটক অন্যরা হলেন- কিশোরগঞ্জের হাফিজ উল্লাহ (২৫), নারায়ণগঞ্জের খায়রুল ইসলাম (২২), সিরাজগঞ্জের রাফিউল ইসলাম (২২), নারায়ণগঞ্জের মেঘনা (১৭), নারায়ণগঞ্জের আবিদা (১২ মাস), পাবনার শাপলা বেগম (২২), জুবেদা (১৮ মাস), হুজাইফা (৬), নাটোরের মাইশা ইসলাম (২০) ও বগুড়ার সানজিদা খাতুন (১৮)। তাদের ঢাকায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকাল শনিবার কুলাউড়ার জঙ্গি আস্তানা থেকে ১০ জনকে আটকের পর তাদের যে নাম সিটিটিসি ইউনিট জানায়, সেখানে নাটোর সদরের চাঁদপুর গ্রামের মাইশা ইসলাম (২০) নাম দেখা যায়। তিনি সিরাজগঞ্জের নিখোঁজ এক চিকিৎসকের স্ত্রী। মাইশার বড় ভাই ওমর ফারুক বলেন, তার বোনের পুরো নাম মাইশা ইসলাম হাফসা। স্বামী সোহেল তানজিম। গত ২৬ জুলাই থেকে স্বামীসহ নিখোঁজ ছিলেন তার বোন। এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় জিডিও করেন তারা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মুহিবুল ইসলাম আজাদ বলেন, প্রথম থেকেই তাদের চলন-বলন অন্যরকম লাগছিল। দীর্ঘ সময় ধরে এলাকাবাসীর মাধ্যমে নজরদারি রাখি। অনেক অভিযোগ এবং ভয়ংকর তথ্য আসতে থাকে তাদের বিরুদ্ধে। বেশ কিছু দিন ধরে অনেক টাকা-পয়সা লেনদেনের খবর আসতে থাকে। এতেই সন্দেহ বাড়ে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App