×

অপরাধ

ভয়ংকর মাদক ‘আইস’ যখন বিপর্যয়ের কারণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৩, ০৯:৩৫ এএম

ভয়ংকর মাদক ‘আইস’ যখন বিপর্যয়ের কারণ
বিপজ্জনক মাদক ক্রিস্টাল মেথের চোরাচালান গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে। চরম আসক্তি সৃষ্টিতে সক্ষম ও ব্যয়বহুল এই ক্রিস্টাল মেথ ইয়াবার চেয়েও ভয়ংকর। এর সেবনকারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তাই এখনই লাগাম টেনে না ধরা গেলে যুব সমাজের বড় একটি অংশ বিপথগামী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রিস্টাল মেথ মাদকটি ‘আইস’ নামেও পরিচিত। শহর এলাকার সচ্ছল পরিবারের যুবকরা এর ভোক্তা। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সম্প্রতি বেশি পরিমাণে তা উদ্ধার হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, দেশে আইসের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। চলতি মে মাসেই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পাচারের সময় র‌্যাব ও বিজিবি কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে প্রায় ৪০ কেজি ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করেছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ঝিগাতলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ক্রিস্টাল মেথ উৎপাদনের ল্যাব অবিষ্কার ও ৩ যুবককে গ্রেপ্তার করে। সে সময় বিষয়টি প্রথম সবার নজরে আসে। ডিএনসির হিসাব অনুযায়ী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ২০২০ সালে ৬৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করে। এরপর প্রতি বছরই তা বাড়ছে। ২০২১ সালে জব্দ হয় ৩৬ কেজি ৭৯৮ গ্রাম। ২০২২ সালে ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম। আর চলতি বছরের প্রথম সাড়ে ৪ মাসে ১০০ কেজিরও বেশি আইস জব্দ হয়েছে। ডিএনসির অপারেশন্স ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক তানভীর মমতাজ বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ওপর ভিত্তি করে আমরা আশঙ্কা করছি যে, আগামী বছরগুলোয় ইয়াবার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে ক্রিস্টাল মেথ। তা ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে। আমাদের আগের অভিজ্ঞতা বলছে, ইয়াবাও ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মাদক বাজারে ঠেলে দেয়া হয়। একইভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে এর দামও ছিল অনেক বেশি। পরে পর্যায়ক্রমে তা সস্তা হতে থাকে। ডিএনসির এক কর্মকর্তা জানান, দেশে ক্রিস্টাল মেথ চোরাচালানের ৩টি বড় রুট রয়েছে। এর সিংহভাগ আসে নাফ নদী হয়ে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত পথে। আরেকটি রুট হলো বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পাহাড়ি সীমান্ত। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, মাদক পাচারকারীরা মিয়ানমারের সিন্ডিকেট থেকে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে ক্রিস্টাল মেথ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে মজুত করে রাখে। পরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। গত ৮ মে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ২৪ কেজির বেশি ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করে র‌্যাব। এখন পর্যন্ত জব্দ হওয়া ক্রিস্টাল মেথের সবচেয়ে বড় চালান এটি। এর ১০ দিন আগে একই জায়গা থেকে বিজিবি উদ্ধার করে ২২ কেজির চালান। এ ছাড়াও ১১ মে টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ইয়াবাসহ ১৪ কেজির বেশি ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করে বিজিবি। যদিও চোরাচালানের সময় কত শতাংশ ধরা পড়ে আর কত শতাংশ লুকিয়ে পাচার হয়ে যায় এ বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। মাদকদ্রব্য নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, মাদকদ্রব্য আটকের ওপর আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১০ শতাংশ ক্রিস্টাল মেথ ধরা পড়ে, বাকিটা পাচার হয়ে যায়। জাতিসংঘের মাদকদ্রব্য ও অপরাধ সংক্রান্ত বিভাগের হিসাবও বলছে, পাচার হয়ে আসা ক্রিস্টাল মেথের মাত্র ১০ শতাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তিনি আরো বলেন, ইয়াবার চেয়েও ক্রিস্টাল মেথ অনেক বেশি বিপজ্জনক। এটি আরো উদ্দীপক। শরীরে দ্রুত প্রভাব ফেলে শরীরের যে কোনো অঙ্গ অকার্যকর করে দিতে পারে। ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, দেশে ক্রিস্টাল মেথের চাহিদা বেড়েছে কারণ এতে মেথামফেটামিনের পরিমাণ ৯৬ শতাংশ। ইয়াবায় তা থাকে ১০-১৫ শতাংশ। অল্প পরিমাণে ক্রিস্টাল মেথ সেবন করলে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ কারণে ইয়াবা আসক্তরা ক্রিস্টাল মেথের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। এছাড়া ক্রিস্টাল মেথ হালকা ও সহজে বহনযোগ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে চিনতে পারে না- যা চোরাকারবারীদের উৎসাহিত করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় এক গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ বা আইস ১০-১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এটি অনেক বেশি উদ্দীপক। তাই ইয়াবা আসক্তরা মনে করে যে, তাদের আরো শক্তিশালী কিছু দরকার। এভাবে তারা আইসে আসক্ত হয়। র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মাদক চোরাচালানের ক্ষেত্রে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমার থেকে এনে চোরাকারবারিরা বেশির ভাগ মাদক ক্যাম্পে মজুত করে। এরপর ছোট চালান বানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে। এপিবিএন-১৪ এর অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে বেশির ভাগ সংঘর্ষ হয় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। যারা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণে জড়িত তাদেরই কেউ কেউ হয়তো মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। তা মারাত্মক সংঘর্ষের দিকেও ধাবিত করে। তবে এসব অপচেষ্টা বন্ধে সবসময় কঠোর নজরদারি রাখাসহ বিভিন্ন সময়েই অভিযান চালানো হচ্ছে। র‌্যাব-১৫ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঠিক বিপরীত পাশের এলাকা থেকে আইসের সবচেয়ে বড় চালানটি জব্দ করা হয়। চোরাকারবারিরা মাদকটি ক্যাম্পে নিয়ে গেলেই তা খুঁজে বের করা খুব কঠিন হতো। কিন্তু আমরা তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছি। এ ঘটনাটি ইঙ্গিত দেয় পাচার রোধে আমরা সতর্ক আছি। ডিএনসির পরিচালক তানভীর মমতাজ বলেন, দেশে ক্রিস্টাল মেথের ক্রমবর্ধমান প্রবেশ নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। এটি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সময়ে সময়ে পাচার রোধে মিয়ানমারের সহযোগিতা চেয়েছে। তবে মূল সমস্যা হলো তাদের অবস্থান সহযোগিতামূলক নয়। এছাড়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মাদক চক্রের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে ও তাদের মাধ্যমে দেশে মাদক আসছে- যা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে মাদক রোধে আমরা সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App