×

সারাদেশ

কাজী আরেফ হত্যার ২২ বছর, ধরা ছোঁয়ার বাইরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০১:৫৫ পিএম

কাজী আরেফ হত্যার ২২ বছর, ধরা ছোঁয়ার বাইরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি

নিহত জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ

কাজী আরেফ হত্যার ২২ বছর, ধরা ছোঁয়ার বাইরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি

নিহত কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ জাসদ নেতা।

কাজী আরেফ হত্যার ২২ বছর, ধরা ছোঁয়ার বাইরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি

যশোর কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হওয়া তিন আসামি আনোয়ার হোসেন, সাফায়েত হোসেন ওরফে হাবিব ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু।

কাজী আরেফ হত্যার ২২ বছর, ধরা ছোঁয়ার বাইরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামি
আজ বেদনাবিধুর ১৬ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপকার কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ জাসদ নেতা হত্যাকাণ্ডের ২২তম বার্ষিকী। এত বছর পেরিয়ে গেলেও আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ আসামির মধ্যে ৫ আসামি এখনো রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তিনজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। অপর একজন কারাবন্দি থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। প্রতি বছর আজকের এই দিনটি সামনে এলেই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় জাসদ নেতাদের মাঝে ভিন্ন রকম এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নিহত জাসদ নেতৃবৃন্দের স্মরণে স্মরণসভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছরেও হাতে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন জাসদ সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ জাসদ নেতা। জাতীয় নেতা কাজী আরেফ আহমেদ প্রধান অতিথির বক্তৃতা শুরু করার পরপরই একদল সশস্ত্র চরমপন্থি চারদিক থেকে মঞ্চে উঠে এসে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে নৃসংশভাবে হত্যা করে। ওই সময় চরমপন্থি সন্ত্রাসীরা মঞ্চে উপস্থিত জাসদ নেতৃবৃন্দকে লক্ষ্য করে অতর্কিত ব্রাশফায়ার শুরু করলে তাদের গুলিতে নিহত হন আরো চার জাসদ নেতা। চরমপন্থিদের ব্রাশফায়ারে নিহত নেতৃবৃন্দরা হলেন- জাসদের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপকার নেতা কাজী আরেফ আহমেদ, কুষ্টিয়া জেলা জাসদের তৎকালীন সভাপতি লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ও দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা শমসের আলী এবং তফসের মণ্ডল। [caption id="attachment_265929" align="aligncenter" width="700"] নিহত কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ জাসদ নেতা।[/caption] সেদিনের সেই সমাবেশ পরিচালনাকারী আমলা সরকারি কলেজের তৎকালীন ছাত্র নেতা কারশেদ আলম (মামলার প্রধান সাক্ষী) এবং অন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সেই বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনায় চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের নানা চিত্র বেরিয়ে আসে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সে সময় পুরো দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঘটনার রাতেই খুলনা রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি লুৎফুল কবিরসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরেরদিন ময়নাতদন্ত শেষে নিজ নিজ এলাকায় নিহত জাসদ নেতাদের দাফন করা হয়। ওই বছরই চরমপন্থি অধ্যুষিত এ উপজেলার কালিদাসপুর ও শ্যামপুরসহ আরো কয়েকটি স্থানে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এসব পুলিশ ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন। দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দৌলতপুর থানার তখনকার ওসি ইছাহাক আলী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় প্রাথমিকভাবে ২৫ জনকে আসামি করা হয়। এর কিছুদিন পর চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডির ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়। সিআইডি তদন্তভার গ্রহণ করার পর তারা দৌলতপুর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লাকে বহুল আলোচিত এ মামলায় জড়িয়ে তাদের দুজনকেও আসামি করে। তবে মামলাটির রায় ঘোষণার আগেই হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ বিএনপি নেতা রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা ও সাবেক ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লাকে মামলা থেকে বেকসুর খালাস দেন। সিআইডির ইন্সপেক্টর নবকুমার দাস দীর্ঘ তদন্তের পর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দিলে হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট কুষ্টিয়া আদালতে মামলাটির রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে ১০ জনকে ফাঁসি, ১২ জনকে যাবজ্জীবন ও তিনজনকে খালাস প্রদান করা হয়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- ইলিয়াস হোসেন ওরফে এলাচ, রাশেদুল ইসলাম ওরফে ঝন্টু, সাফায়েত হোসেন হাবিব, আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু, শহিরুদ্দিন, মান্নান মোল্লা, বাকের উদ্দিন, রওশন জাহান, জাহান আলী ও জালাল উদ্দিন। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- রাফাত ওরফে রাফা, গারেস, তাসিরুদ্দিন, আসগর জোয়ারদার, নজরুল ইসলাম, ওয়ালিউর রহমান, একুব্বার, টিক্কা ওরফে জাব্বার, লাবলু, ফিরোজ ওরফে ফরু, লাল্টু ওরফে নুরুজ্জামান। [caption id="attachment_265930" align="aligncenter" width="700"] যশোর কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হওয়া তিন আসামি আনোয়ার হোসেন, সাফায়েত হোসেন ওরফে হাবিব ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু।[/caption] এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করলে ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট আদালত একজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১২ আসামিকে মামলা থেকে খালাস দেন। এরপর খালাসপ্রাপ্ত সব আসামির বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। পাশাপাশি কারাগারে থাকা মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই আসামি রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু ও আনোয়ার হোসেন খালাস চেয়ে লিভ টু আপিল করেন। আবেদনগুলোর শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৭ আগস্ট আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল নিষ্পত্তি করেন। হাইকোর্টের রায় বহাল রাখায় রাশেদুল ও আনোয়ারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এরপর আসামি রাশেদুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন রিভিউ আবেদন করেন। ওই আবেদনের শুনানি শেষে তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করেন আপিল বিভাগ। এ নিয়ে এই মামলায় মোট ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। আপিলের রায়ে হাইকোর্ট যাবজ্জীবনপ্রাপ্তদের দণ্ড থেকে খালাস দেয়ার পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শহিরুদ্দিনকেও খালাস দিয়ে দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি আসামিদের দণ্ড কার্যকরের অনুমতি দেন হাইকোর্ট। আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম ঝন্টুর পুনর্বিবেচনার আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল আপিল বিভাগ দণ্ড কার্যকরে স্থগিতাদেশ দেন। ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর রিভিউ আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন। এ হত্যা মামলায় ৯ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে ২০১৬ সালের ৯ জানুয়ারি যশোর কারাগারে বন্দি তিনজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ওইদিন গভীর রাতে যে তিনজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় তারা হলেন, কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কুর্শা গ্রামের মৃত উম্মত আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন, একই উপজেলার রাজনগর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে সাফায়েত হোসেন ওরফে হাবিব ও দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া গ্রামের সিরাজ উদ্দিনের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু। মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর ৫ আসামি এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। পলাতক এই আসামিরা হলেন, দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের শেরপুর পচাভিটা গ্রামের মান্নান মোল্লা, একই ইউনিয়নের বালিয়াশিসা গ্রামের হারেজ উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দিন, দৌলতপুর সদর ইউনিয়নের কিশোরীনগর গ্রামের মোজাহার উদ্দিনের ছেলে বাকের উদ্দিন, পার্শ্ববর্তী মিরপুর উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের মেহেরনগর গ্রামের রমজান আলীর ছেলে জাহান আলী এবং মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার নায়েব মণ্ডলের ছেলে রওশন জাহান। এ ছাড়া কারাগারে থাকা অবস্থায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি ইলিয়াস হোসেন ওরফে এলাচ মারা গেছেন। এদিকে কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ জাসদ নেতা হত্যার ২২তম বার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর হাইস্কুল মাঠে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন, কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সরওয়ার জাহান বাদশাহ্। বিশেষ অতিথি ছিলেন, জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আলীম স্বপন, কেন্দ্রীয় জাসদের জনসংযোগ বিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয় যুবজোটের সভাপতি শরিফুল কবির স্বপন, দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এজাজ আহমেদ মামুন, ভেড়ামারা পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র জাসদ নেতা আনোয়ারুল কবির টুটুল। এর আগে শহীদ ইয়াকুব আলী স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে ফিলিপনগরে তার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন নেতারাসহ সর্বস্তরের মানুষ। বেলা ১২টায় ঘটনাস্থল কালিদাসপুরে শোকসভা, মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া কাজী আরেফ পরিষদের উদ্যোগে বিকেলে কুষ্টিয়া পৌরসভার 'বিজয় উল্লাস' চত্ত্বরে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে জাসদের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App