×

সারাদেশ

তাবিজের আড়ালে রমরমা মাদক ব্যবসা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৩:১৯ পিএম

তাবিজের আড়ালে রমরমা মাদক ব্যবসা
নোয়াখালীর সদর উপজেলার এওজবালিয়া ইউনিয়নের ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামের বেদে পল্লীতে প্রায় ৫’শ পরিবারে ৩ হাজারের বেশি বেদের বসবাস। বেদে পল্লীর মানুষগুলো এক সময়ে বন-বাঁদারে সাপ খুঁজে বেড়াত। সাপ খেলা দেখিয়ে, তাবিজ-কবজ দিয়ে এবং সিঙ্গা লাগিয়ে মানুষের টোটকা চিকিৎসা করে জীবিকা নির্বাহ করতো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন সেই সবই অতীত এবং ইতিহাস। সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামে বসবাস শুরু করা বেদেরা। এখানে বসবাসের পর বেদেদের মধ্যে একটি দল রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শুরু করে মাদক (ইয়াবা, ফেন্সিডিল, মদ ও গাঁজা) ব্যবসা। অতি লাভের আশায় সাপের বাক্স, সস্তা চুড়ি বা কসমেটিকের ঝাপিতে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় তাবিজ-কবজের আড়ালে ওই মাদক বহন এবং বিক্রি করে আসছে তারা। এখন নোয়াখালী সদরের বেদে পল্লী মাদকের ছয়লাব হয়ে উঠেছে। হাত বাড়ালেই ওই এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে মাদকদ্রব্য। বেদে পল্লীর কড়ই তোলা, মুন্সি বাজার ও শাজাহান খোনার মসজিদ এলাকায় ইয়াবা, ফেন্সিডিল, মদ ও গাঁজার মতো মাদক দ্রব্য কেনা-বেচা হচ্ছে প্রতিনিয়তই। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, বেদে সম্প্রদায়ের অনেক সর্দার মাদক বিক্রয় করছেন এবং অনেকে মাদক বিক্রেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে মাসিক বা সাপ্তাহিক ভাতা নিচ্ছেন। এছাড়া বেদেপাড়ার ৫-৬ জন মাদক গডফাদার মিলে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পুঁজি সংগ্রহ করে ওই টাকা দিয়ে সাভার, চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা থেকে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, মদ ও গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য কিনে এনে বেদে পল্লীতে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করছেন। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের গডফাদারদের বিষয়ে জানতে চাইলে বেদে সম্প্রদায়ের একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এওজবালিয়ার দুটি ওয়ার্ডে মাদকের বড় কারবারি হলেন, বাদশা মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম, বেলাল হোসেনের ছেলে মো. রাসেল, রাখালের ছেলে আলমগীর, উরিয়া মিয়ার ছেলে টুকু। এরা সাভার, চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে বড় বড় মাদকের চালান নিয়ে আসেন বেদে পল্লীতে। এদের মাদকের সাব-ডিলার হিসেবে মোহাম্মদ আলীর ছেলে মো.মিজান, ছোরত আলীর ছেলে ওসমান, রাজু মিয়ার ছেলে আরিফ, পিওর মিয়ার ছেলে সোহেল, সফর আলীর ছেলে টাকলা জাকির, রুহিত মিয়ার ছেলে ওয়াসিম পেন্সিল, মাতু মিয়ার ছেলে তাহের, জাকির সরর্দার, মোস্তাক, তরিকুল হাসান, রোকন, বেনু বেগমসহ বেশ কয়েকজন সহযোগী নিজে এবং তাদের ঘরের মহিলাদের দিয়ে ভোর এবং গভীর রাতে আশপাশের এলাকায় মাদক (ইয়াবা) বিক্রি করেন। ইয়াবার বড় চালানগুলো বেদে পল্লীতে পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করেন ভাসমান বেদেরা। বেদেদের মধ্যে মো. সেলিমের ছেলে নবীন ও রাখাল করেন গাঁজার ব্যবসা। বেদে পল্লীর দু-একটি ঘরে জুয়া এবং নারীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগও করেন তারা। মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছোরত আলীর ছেলে ওছমান ইয়াবার মামলায় চট্রগ্রাম জেল হাজতে, রাখালের ছেলে আলমগীর ইয়াবা মামলায় কক্সবাজার জেল হাজতে রয়েছেন। মাদক মালায় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন রাজু মিয়ার ছেলে আরিফ। জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বেদে পল্লীর মাদক ব্যবসায়ী তরিকুল হাসানকে মাদকের একটি চালানসহ গ্রেপ্তার করে জেলা ডিবি পুলিশ। এরআগে ২০১৪ সালে মাদক ব্যবসায়ী মো. মোস্তাককেও মাদকসহ গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে তাকে ভ্রাম্যমান আদালতে সাজা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল বেদে পল্লীতে মাদকের বেচা-কেনা নিয়ে দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ১০জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে বেদে সোহাগ জানান, তাদের সরর্দার জাকির ও তার মেয়ের জামাই ওয়াসিম পিন্সিল কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে বেদে পল্লী এবং আশপাশের এলাকায় বিক্রি করায় তারা বাঁধা দেয়। এতে মাদক ব্যবসায়ী জাকির সরর্দার ও তার সহযোগীরা সোহাগদের উপর হামলা চালায়। বেদে পল্লী যুবসমাজের সভাপতি ও সদর্রার মো.ফরহাদ হোসেন বলেন, গুটিকয়েক মাদকের ডিলার, বিক্রেতা ও সেবীর কারণে বেদে পল্লীর শৃঙ্খলা বিনষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বেদেদের দুরত্ব তৈরী হচ্ছে। তিনি বলেন, বেদে পল্লীর মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের নাম ইউনিয়ন পরিষদ ও থানা পুলিশকে জানিয়েছেন তারা। বেদে পল্লীর শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রশাসনের সহযোগিতা চান বেদেরা। স্থানীয় ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, মাদকদ্রব্য এখন বেদে পল্লীতে সীমাবদ্ধ নয়, তারা পুরো এলাকায় মাদক ছঁড়িয়ে দিয়েছে। সমাজের বিত্তবান পরিবারের যুবক থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষরাও পিছিয়ে নেই বেদে পল্লীর মাদক গ্রহণ থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ প্রায় বেদে পল্লীতে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। মাঝে-মধ্যে মাদক ব্যবসায়ী ও বিক্রেতাদের ধরেনও। তারপরও মাদক ব্যবসা থামানো যাচ্ছেনা। এওজবালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস জাহের বলেন, বেদেরা বসবাসের পর থেকেই হাতেগনা দু-চারজন বেদে মাদক বিক্রির সাথে জড়িত বলে খবর পাওয়া গেছে। বর্তমানে ওই বেদে পল্লীতে মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। আমরা গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে বেদে পল্লীর মাদক বিক্রেতাদের খোঁজখবর নিয়ে থানায় তাদের নাম পাঠিয়েছি। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন এ জনপ্রতিনিধি। সুধারাম মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ সাহেদ উদ্দিন বলেন, ইতিপূর্বে বেদে পাড়ার বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। বেদেদের মধ্যে দুটি গ্রুপ থাকায় তারা মাদকসহ যাবতীয় বিষয়ে একে-অপরকে দোষ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওসি বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের কোন ছাড় নেই। মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App