থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রে চলছে ছিনতাই ও লুটতরাজ
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন ও জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৪ শতাধিক থানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। আন্দোলনকারীদের হামলা ও পিটুনিতে নিহত হন অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য। আহত হয়েছেন কয়েকশ পুলিশ সদস্য।
এরপর থেকে গত ৩ দিন ধরে থানাগুলো পুলিশ শূন্য হয়ে পড়ে আছে। আর এই সুযোগে বিভিন্ন পাড়া মহল্লার কিশোর গ্যাং, ছিনতাইকারী, ডাকাত চক্র, টোকাই ও কিছু দুর্র্বৃত্ত ছিনতাই-ডাকাতিতে নেমেছে। দিনে দুপুরে ও রাতের আঁধারে বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়ি ও দোকানপাট লুটপাট হওয়ার ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলছে। ডাকাতের ভয়ে আতঙ্কে পাড়া-মহল্লা পাহারা দিয়ে নির্ঘুম রাত কাটানো অব্যাহত রেখেছেন এলাকাবাসী।
গত বুধবার রাতভর দেশের প্রায় সব শহর-উপশহরে ছিল ডাকাত আতঙ্ক। ডাকাত ধরতে বিভিন্ন এলাকার মসজিদ থেকে মধ্যরাতে মাইকিং করে বাসিন্দাদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো হচ্ছে। ডাকাত দলের সদস্যদের হাতে আধুনিক অস্ত্র থাকায় আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকজন ডাকাত আটক হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
অনেককে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। তবে থানা হাজত অরক্ষিত থাকায় তাদের কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কারাগার ভেঙে পালানো অনেক দুর্ধর্ষ অপরাধীও চুরি, ছিনতাই এবং ডাকাতিতে নেমেছে বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থানাগুলো থেকে রাইফেল, পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ বিভিন্ন ধরনের কয়েক হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও
গুলি লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা। ওই অস্ত্রগুলোই এখন বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি ও লুটপাটে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় ডাকাত ও ছিনতাইকারীরা বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে জেলপালাতক আসামিরা ফিরছে পুরানো রূপে।
যদিও আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্তসংখ্যক সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য সারাদেশে মোতায়েন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ডাকাত ও ছিনতাইকারীকে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছে জনতা। তবে দ্রুতই যদি লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করা না যায় এবং পুলিশকে কাজে ফেরানো না যায়- তাহলে এই ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১২ নম্বরের সি ও ডি ব্লক, মিরপুর-১০ নম্বর, ইসিবি চত্ত্বর, কাজীপাড়া, ধানমন্ডি, বসিলা, আদাবরের জাপান গার্ডেন সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আশপাশের এলাকা, ডেমরা হাজীনগর, উত্তরা ৬, ১১ ও ১২ নম্বর সেক্টর, উত্তরা হাউজবিল্ডিং এলাকার ৬ নম্বর রেলগেট এলাকা, রামপুরা, কামরাঙ্গীরচর, ওয়ারীর বিভিন্ন দোকানপাটে, কালশী, মানিকদির বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
সাভারের তালবাগ, ভাগলপুর, ব্যাংক কলোনি, গেন্ডা, পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার মদিনা রডের দোকান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) এলাকার আমবাগান ও পান্দুয়ায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সাভারের দিলকুশা এলাকা থেকে গুলির শব্দ পাওয়া গেছে।
এছাড়া গাজীপুরের সফিপুর বাজারসংলগ্ন আন্দারমানিক এলাকা, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, সিলেট, ঝিনাইদহ, যশোরসহসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। অনেকে ফেসবুকে লাইভ করে লুটপাটকারীদের তাণ্ডব তুলে ধরেছেন। অনেকে ফেসবুকে পোস্ট করে সহযোগিতা চেয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসব ডাকাতি ও লুটপাটের ভিডিওতে সয়লাব।
মিরপুরের বাসিন্দা সাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, কয়েক দিন ধরে মিরপুর এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। গতকাল (বুধবার) রাতে ইসিবি এলাকায় কয়েকজন ডাকাতকে অস্ত্রসহ আটক করে ছাত্র-জনতা। পরে তাদের সেনা সদস্যদের হাতে তুলে দেয়া হয়। কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা সোমা আক্তার জানান, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির খবর ফেসবুকে দেখে আমরা খুবই আতঙ্কিত ছিলাম। এরই মধ্যে গত বুধবার রাত ১১টার দিকে ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার শুনতে পাই। এলাকার অনেকে ফেসবুকে পোস্ট করে সহযোগিতা কামনা করে।
কয়েকটি বাড়ি থেকে লুট করে পালিয়ে যায় ডাকাতরা। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা এস এম আব্বাস জানান, তিন রাত ধরে মোহাম্মদপুরে ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, চানমিয়া হাউজিং ও নবোদয় হাউজিংসহ বেশ কিছু এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। বুধবার রাতে নবোদয় হাউজিং থেকে কয়েকজনকে আটক করে সেনাবাহিনীর কাছে দেয়া হয়েছে। এলাকাবাসী ডাকাত আতঙ্কে সারা রাত নির্ঘুম থাকছে। মানুষের মধ্যে সার্বক্ষণিক আতঙ্ক বিরাজ করছে। ডাকাতি প্রতিরোধে ছাত্র-জনতার সহযোগিতা এবং মসজিদ থেকে করা মাইকিংয়ে উপকৃত হচ্ছেন এলাকাবাসী।
উত্তরার রাজল²ী মার্কেট, হাউজ বিল্ডিং ও আজমপুর এলাকায় নিরীহ লোকজনের মোবাইল ফোন ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। উত্তরখানের বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, ছিনতাইয়ের সময় কয়েকজনকে আটক করে গণধোলাই দেয়া হয়েছে। সেখান টহলরত আনসার সদস্যরা আটককৃতদের সেনাবাহিনীর হাতে সোপর্দ করেন। যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা জানান, গত সোমবার সরকার পতনের দিন সন্ধ্যা থেকে রাতভর আওয়ামী লীগের স্থাপনা ও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। তবে মঙ্গলবার ও বুধবার সাধারণ মানুষের বাড়িঘরেও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
বাসিন্দারা জানান, থানা পুলিশ না থাকায় দুর্বৃত্তরা ডাকাতি ও লুটপাট করছে। আবার সন্ধ্যার পর থেকে পথচারী ও যানবাহন থামিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। থানার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এসব ঘটনায় মামলা কিংবা জিডি করতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের ধারণা লুট হওয়া অস্ত্র লুটপাট ও ডাকাতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ আবারো কর্মক্ষেত্রে ফিরতে শুরু করেছে। থানাগুলোতে কার্যক্রম শুরু হলেই এ ধরনের কাজ কমে আসবে। থানার কার্যক্রম শুরুর পর দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করায় জোর দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের আরেক কর্মকর্তা।
লুণ্ঠিত অস্ত্র জমা দেয়ার আহ্বান : র্যাব হেডকোয়ার্টার্স গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি বা পুলিশ লাইন থেকে লুট করা/হারানো অস্ত্র ও গোলাবারুদ; স্বেচ্ছায় নিকটস্থ র্যাব কার্যালয়/ব্যাটালিয়নে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।