×

সারাদেশ

নারায়ণগঞ্জে গ্যাস থেকে অগ্নি দুর্ঘটনা যে কারণে এত বেশি

Icon

কাগজ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০০ এএম

নারায়ণগঞ্জে গ্যাস থেকে অগ্নি দুর্ঘটনা যে কারণে এত বেশি

ছবি: সংগৃহীত

সারাদেশের তুলনায় নারায়ণগঞ্জে গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড বেশি। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, এখানে সপ্তাহে গড়ে প্রায় দুটি এ ধরনের দুর্ঘটনা হয়। তাতে প্রাণহানির পাশাপাশি সম্পদেরও ক্ষতি হচ্ছে। এসব ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অবহেলা ও সাধারণ মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করা হলেও প্রতিকারের কোনো বাস্তব উদ্যোগ দেখা যায় না। শ্রমিক অধ্যুষিত জনবহুল নারায়ণগঞ্জ জেলায় গত কয়েক বছরে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ও আগুনে হতাহতের ঘটনা যেন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলায় ৩১৫টি গ্যাস সংক্রান্ত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। অর্থাৎ, প্রতি চার দিনে একটি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে গ্যাসের কারণে। এর অধিকাংশ হয়েছে তিতাস গ্যাসের লাইনে লিকেজ থাকার কারণে। কয়েকটি ঘটনায় এলপিজি সিলিন্ডার থেকেও অগ্নি দুর্ঘটনার খবর এসেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ১৩৬ জন হতাহত হয়েছেন।এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত মসজিদে। গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে সেখানে প্রাণ যায় ৩৪ জনের। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত চারটি গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় ২৪ জন দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে পাঁচজনের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারাদেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে গ্যাসের লাইন লিকেজ থেকে ৭৭০টি আগুন লাগে যা মোট হিসাবের ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আর গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ থেকে ১২৫টি অগ্নিকাণ্ডের তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ঘন ঘন গ্যাস বিস্ফোরণের এই ঘটনার পেছনে তিতাসের পুরোনো লাইন নিয়মিত তদারকি না করা, গ্রাহকদের অবৈধ সংযোগ ও সংযোগে কারচুপি এবং বাসাবাড়িতে গ্যাস ও সিলিন্ডারের চুলা ব্যবহারে লোকজনের অসচেতনতাকে কারণ হিসেবে সামনে আনছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

ফায়ার সার্ভিসের তালিকা অনুযায়ী, গ্যাসের কারণে সৃষ্ট আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়। এ দুটি এলাকায় কয়েকশ শিল্প-কারখানায় থাকায় সেখানে ঘনবসতি বেশি। তাছাড়া প্রায়ই সোনারগাঁ, আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ উপজেলারও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। এই তালিকায় রয়েছে বন্দর উপজেলারও কয়েকটি এলাকা।  

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ঘটছে বাসাবাড়িতে। শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও এই ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। বাসাবাড়ির ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা পরিদর্শনে গিয়ে যা দেখি তা হচ্ছে, চুলার সঙ্গে গ্যাসের পাইপ লাইন ও সিলিন্ডারের লাইনে লিকেজ থাকে। সেখান দিয়ে গ্যাস বের হয়ে যদি বাইরে না যেতে পারে তখন তা ঘরের ভেতরে জমা হয়ে থাকে। গ্যাস জমা ওই ঘরে বৈদ্যুতিক স্পার্ক বা চুলা জ্বালাতে গেলে সেই আগুন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনাগুলো সাধারণত শীতকালে বেশি হয় জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, শীতকালে বেশিরভাগ সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ থাকে। তখন ঘরে গ্যাস জমার সুযোগ থাকে বেশি। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে জনসাধারণের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। 

 নারায়ণগঞ্জ জেলায় আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। নারায়ণগঞ্জের ৫ উপজেলায় প্রায় ৬৬ হাজার বৈধ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। এ ছাড়া ৫৯১ শিল্প কারখানাও রয়েছে তিতাসের গ্যাস সংযোগের তালিকায়। এই প্রতিষ্ঠানের নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. আনিসুর রহমানের দাবি, এই ধরনের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী প্রধানত গ্রাহকদের অসচেতনতা। তিতাস আবাসিক ভবনের প্রধান লাইনে সংযোগ দেয় কিন্তু চুলার সঙ্গে সংযোগ ভবন মালিকরা দিয়ে থাকেন। সেখানে যদি কোনো প্রকার লিকেজ হয় তা বদ্ধঘরে থাকে, পরবর্তীতে আগুনের সংস্পর্শে তা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটায়।

আনিসুর রহমান বলছিলেন, অনেক সময় বিভিন্ন সংস্থা তাদের কাজ করতে গিয়েও মাটির নিচ দিয়ে নেয়া আমাদের মূল বিতরণকারী লাইনে ছিদ্র করে ফেলে। এই লিকেজ সম্পর্কে না জানার আগে আমাদের কিছু করার থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ সংযোগ নেওয়ার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

 গ্যাসের আগুনে পোড়া রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। এই ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক মো. তরিকুল ইসলাম বলছেন, গৃহস্থালীতে ব্যবহৃত গ্যাস থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এর শিকার হচ্ছে বেশি। ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে বলছেন তিনি।

আমরা কিন্তু উচ্চবিত্ত বা একেবারেই দরিদ্র রোগী পাচ্ছি না। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কোনো বহুতল ভবনে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন, তারা এই ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছেন বেশি।

চিকিৎসক বলেন, লাইন বা সিলিন্ডার থেকে লিকেজ হওয়া গ্যাস বদ্ধ পাকা ঘরে জমে থাকতে পারে, সেখান থেকেই ঘটে দুর্ঘটনা। মূল ঢাকা শহরে এই ধরনের ঘটনা কম। ঢাকার আশপাশে সাভার, ধামরাই, আশুলিয়া, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এসব এলাকা থেকে রোগীরা বেশি আসছেন। গ্যাস থেকে দুর্ঘটনার পরিমাণ অবশ্যই বেড়েছে। তবে আমাদের রেজিস্টারে যে কোনো গ্যাসের আগুনে পোড়া রোগীদের ফ্লেইম বার্ন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেটা সিলিন্ডার গ্যাস না লাইনের গ্যাস সেটা পৃথকভাবে উল্লেখ করা থাকে না। এ জন্য সিলিন্ডার গ্যাস লিকেজের কারণে কয়টা ঘটনা ঘটল সেটা পৃথকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে পেশেন্ট ডিল করতে গিয়ে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি সাম্প্রতিক সময়ে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে গ্যাস থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App