×

সারাদেশ

প্রথম প্রতিরোধে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন আব্দুল আলী

Icon

দেওয়ানগঞ্জ ( জামালপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৪ পিএম

প্রথম প্রতিরোধে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন আব্দুল আলী

পাক হানাদার বাহিনীর হামলা আঁচ করতে পেরে স্বাধীনতার জন্য নিজের চাকুরির মায়া তুচ্ছ করে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রির প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল আলী। কিন্তু কারো কোন সাড়া না পেয়ে তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে না পেরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিজেই বাজিয়েছেন পাগল  ঘণ্টা। পাগলা ঘণ্টার শব্দ শুনে সালামি গার্ডের শত শত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এসে জড়ো হয়। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে, অস্ত্র লুট করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন পুলিশ বাহিনীর এই সদস্য। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম প্রতিরোধের ঘটনা। 

এ ব্যাপারে আব্দুল আলী বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাত ১১ টার দিকে শেখ কামালের দিকনির্দেশনা পেয়ে তিনি পাগলা ঘণ্টা বাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেদিন নিজের মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন ২১ বছর বয়সের টগবগে যুবক আব্দুল আলী খান। 

তিনি তৎকালীন পুলিশের আইজিপি তসলিম উদ্দিন খান এর বডিগার্ড ছিলেন। ডিউটি শেষ করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করে রাত সাড়ে ৯ টার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ফিরছিলেন। তিনি থাকতেন ৬ নাম্বার ব্যারাকের তৃতীয় তলায় । সেই ভবনের নিচতলায় তখন ঢাকা জেলা পুলিশের অস্ত্রাগার ছিল। সেদিন ডিউটি থেকে ফেরার পর আব্দুল আলীর মনে অস্থিরতা বেড়ে যায়। আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে এমনটাই আশঙ্কা করছিলেন তিনি। রাত ১০ টা দশ মিনিটে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। এই রাতে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাবে কেন? পুলিশ বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা টর্চ লাইট দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেন। শহরের অন্যান্য স্থানে কি হচ্ছে সেই খবর জানতেই তৃতীয় তলায় ওঠেন এবং তিনি দেখতে পান পুরো ঢাকা শহর অন্ধকার বিদ্যুৎবিহীন। হঠাৎ একটা মোটরবাইক ১ নং গেটে ঢুকে পরতে দেখেন। তিনি আব্দুল আলী কে জানান আজ পঁচিশে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাক বাহিনী ঢুকে আক্রমণ করবে বঙ্গবন্ধু সব পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের তাদেরকে প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার নাম শেখ কামাল। 

এ সময় তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের সাড়া না পেয়ে নিজেই পাগলা ঘণ্টা বাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। পাগলা ঘণ্টা শুনে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সবাই ছুটে আসে সালামি গার্ডের সামনে।  দুজন সদস্য সেদিন সেন্ট্রির দায়িত্ব পালন করছিল।  তাদের একজনকে ঘণ্টা বাজানোর দায়িত্ব দিয়ে তিনি চলে যান অস্ত্রাগারের চাবি আনতে। তখন আব্দুল আলী পাগল প্রায়। অস্ত্রাগারের চাবি তো তার হাতে নেই তিনি কি করবেন। একজন সেন্ট্রিকে নির্দেশ দেন গুলি করে তালা ভেঙে ফেলতে। গুলি করে তালা ভেঙে ফেলে অস্ত্রাগারে ঢুকে পরেন আব্দুল আলী। পুলিশ সদস্যদের হাতে বিভিন্ন রকম অস্ত্র তুলে দেন তিনি। রাত বারোটার পর শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। গুলির শব্দে কান পাতা যাচ্ছিল না, অস্ত্র হাতে গুটি শুঁটি হয়ে বসে থাকি সম্মুখ যুদ্ধ করতে পারিনি। ভোরের দিকে চলে যান পুলিশ টেলিকম ভবনের পাশে, সেখান থেকে পুলিশ হাসপাতালে। এরপর বিভিন্ন স্থান হয়ে নারায়ণগঞ্জে। পাঁচ দিন হেঁটে হেঁটে চলে যান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে এখানেই কাটিয়েছেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি তিনি পূর্বের কর্মস্থলে যোগ দেন। 

কিন্তু ১৯৭৭ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আব্দুল আলীর জীবনে অমাবস্যা নেমে এলো। বিশেষ ট্রাইবুনালে তার নামে মামলা হলে, বিচারে এক মাসের জেল হলো এবং চাকরি হারালেন তিনি। এক মাস জেল খেটে সোজা চলে গেলেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের চিকাজানী নিজ গ্রামে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। চাকরি হারিয়ে বাকি সারা জীবন দুঃখ কষ্ট আর অভাব অনটনে পার করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। 

জীবনের পড়ন্ত বিকেলে আজ ২৫ শে মার্চ ২০২৪ রাতে তার সঙ্গে সেসব দিনের স্মৃতিচারণ শুনতে চাইলে তিনি দরাজ কণ্ঠে বলেন আগামীকাল এসপি সাহেব আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, সেখানে যাব। সময় করে আমি আপনাদের সব ঘটনা তুলে ধরব।  দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ বিপ্লব কুমার বিশ্বাস জানান, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গর্বিত পুলিশ বাহিনীর সদস্য। তিনি আমাদের অহংকার ২৬ শে মার্চ এসপি স্যার তাকে সংবর্ধনা দিবেন। 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App