×

সারাদেশ

শিক্ষক-কমিটির দ্বন্দ্ব

৫ শিক্ষকের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৪

Icon

মোহাম্মদ সোহেল, নোয়াখালী

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৫৬ পিএম

৫ শিক্ষকের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৪

ছবি: ভোরের কাগজ

সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা থাকলেও শিক্ষকের সঙ্গে ম্যানেজিং কমিটির দ্বন্দ্বের জেরে ৫ শিক্ষকের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪জন। এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কাদরা ইউনিয়নের নন্দীরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। 

এ বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন মোট ৫জন। ফলে পরিপাটি শ্রেণীকক্ষে ক্লাসের সময় সব আসন ফাঁকাই থাকছে। আর ক্লাস না নিয়ে প্রতিনিয়ত অলস সময় কাটান শিক্ষকরা। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন এলাকাবাসী।

বুধবার (২৪ জানুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সহকারী শিক্ষক হোসনে জাহান নুর, মো. ফারুক হোসাইন’সহ তিন শিক্ষক অফিসে বসে আছেন। একজন প্রাক-প্রাথমিকের পাঠ পরিকল্পনা প্রস্তুত করছেন। আর সহকারী শিক্ষক জহিরুল আলম সকালে এসে স্বাক্ষর দিয়ে চলে গেছেন ছুটিতে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত সব শ্রেণি মিলিয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছে মাত্র চারজন। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয়টির এ দৃশ্য নতুন নয়। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন রাশেদা আক্তার। বিদ্যালয়ের নাজুক পরিস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়ায় তদন্ত রিপোর্টের পর তাকে সদ্য অন্য বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই শিক্ষার্থী হারাতে থাকে এই বিদ্যালয়। কমতে কমতে এখন মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৪জনে। এতে ক্লাস নেয়ার পরিবেশ না থাকায় চার শিক্ষক ঘুরে ফিরে সময় কাটান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, এক বছর আগে ছেলেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রিডিং পড়তে পারে না। এখানে লেখাপড়ার মান খারাপ। এজন্য কেউ সন্তানদের এখানে ভর্তি করাতে চান না। সবাই সন্তানদের আশপাশের অন্যান্য বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন। এমন পরিস্থিতির জন্য অশোভন আচরণ ও অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দ্বন্দ্বের কথা বলছেন স্থানীয়রা।

তবে প্রধান শিক্ষিকার অভিযোগ, বিদ্যালয়ে পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের নিষেধের কারণে লোকজন তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়টিতে ভর্তি করান না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ২০০৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান সহকারী শিক্ষিকা রাশেদা আক্তার। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত ক্লাস নিতেন না। চার-পাঁচ বছর ধরে একেবারেই ক্লাস নেন না। তার দায়িত্ব অবহেলার কারণে অন্য শিক্ষকেরাও নিয়মিত আসেন না। এ কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এ বিদ্যালয়ে দিচ্ছেন না।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হোসনে জাহান নুর, মো. ফারুক হোসাইন বলেন, এখানে আমাদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কমিটির লোকজনের মতের অমিল থাকায় বিদ্যালয়ে কিছুটা শিক্ষার্থী সংকট দেখা দেয়। দু’দিন আগে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে অন্যত্র সংযুক্ত করা হয়। এখন আমরা উপজেলা শিক্ষা অফিসের নির্দেশক্রমে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা ক্রমে উঠোন বৈঠক, শিক্ষার্থী বাড়ি বাড়ি ভিজিট করে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম জোরালো করেছি। গত দুইদিনে আমাদের এখানে নতুন ২০জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছে। অচিরেই এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট কমিয়ে শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনা হবে বলে আশাবাদী এই শিক্ষকরা।

বিদ্যালয়ের এমন করুন পরিস্থিতির জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাশেদা আক্তারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসদাচরণকে দুষলেন দাতা সদস্য মোশারফ হোসেন ও কমিটির সহ-সভাপতি মো. মহিন উদ্দিন ও সদস্য মিজানুর রহমানও।

অভিযোগের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা রাশেদা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, পরিচালনা কমিটির সভাপতি কোনো মিটিংয়ে আসেন না। বিভিন্ন তহবিল থেকে আপ্যায়ন বিলসহ নানা অজুহাতে কমিশন চান। না দেয়ায় তিনি কমিটির অন্য সদস্যদের এবং স্থানীয় মানুষজনকে ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে দিতে নিষেধ করে দিয়েছেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও কমিটির সভাপতির কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করছেন না অভিভাবকরা। 

কমিটির সভাপতি মানিক মিয়া অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে কাজ না করে বিভিন্ন ভুয়া ভাউচারে স্বাক্ষর করার জন্য আমাকে চাপ দেন। স্বাক্ষর না করায় এবং তার কথামতো ভুয়া ভাউচারে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে না দেয়ায় তিনি আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করছেন।

স্থানীয় কাদরা ইউপি চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, প্রধান শিক্ষিকার অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার জেরে কমিটির লোকজনসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দ্বন্দ্বের কারণে বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা আমাকে জানিয়েছেন, প্রধান শিক্ষককে স্থায়ীভাবে এখান থেকে অপসারণ করা না হলে সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন না।

উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. আব্বাছ আলী বলেন, ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কমিটির লোকজনের দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষার্থী সংকটের অভিযোগ পেয়ে আমরা সরেজমিনে তদন্তপূর্বক জেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর প্রতিবেদন পেশ করলে ওই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে অন্য বিদ্যালয় সংযুক্ত করা হয়। আশা করছি শীঘ্রই ওই বিদ্যালয়ের সংকট কেটে যাবে।

সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিসান বিন মাজেদ বলেন, ২০২২ সালে ম্যানেজিং কমিটি ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার দ্বন্দ্বের জেরে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক মাস আগে এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App