×

সারাদেশ

টাঙ্গাইল পৌরসভায় কোটি টাকার ‘নম্বর প্লেট’ বাণিজ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২০, ০৯:৪৩ পিএম

টাঙ্গাইল পৌরসভায় কোটি টাকার ‘নম্বর প্লেট’ বাণিজ্য

ফাইল ছবি

অবৈধ অটোরিকশাকে বৈধতা দিতে টাঙ্গাইল পৌরসভা চালু করছে নিজস্ব নম্বরপ্লেট সিস্টেম। আর এই সিস্টেমে জড়িতরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যের ফাঁদ তৈরি করেছে। সরকারিভাবে পৌরসভার ফি ১০ হাজার ৫০০ টাকা নেয়ার কথা থাকলেও প্রতিটি অটোরিকশার নম্বর প্লেট বাবদ ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ।

এভাবে অবৈধকে বৈধকরণ ‘বাংলাদেশ পৌরসভা আইন ২০০৯’ এর পরিপন্থি। বাণিজ্যের কারণেই আগের চেয়ে এক হাজার অটোরিকশা বাড়ানো হয়েছে। এতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে যানজট বেশি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয়রা বলছেন, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে টাঙ্গাইল পৌর এলাকা। এছাড়া ইজিবাইকের বেপরোয়া চলাচল ও চালকের অদক্ষতার কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

এদিকে, যানজটের চরম ভোগান্তি ও দুর্ভোগ থেকে শহরবাসীকে রেহাই দিতে ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ৩ হাজার অটোরিকশাকে দুই শিফটে ভাগ করে দেয়া হয়। এক হাজার পাঁচশ অটোরিকশাকে লাল রং ও অপর এক হাজার পাঁচশ অটোরিকশাকে হলুদ রঙে চিহ্নিত করে দেয়া হয়। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এক রঙের অটোরিকশা চলবে আর দুপুর ২টা হতে রাত ৮টা পর্যন্ত আর অপর অটোরিকশাগুলো শহরে চলাচল করতে হবে। তবে দুই শিফট করার পরও টাঙ্গাইল শহরে অটোরিকশাজট মুক্ত হয়নি।

তবে সম্প্রতি করোনার কারণে টাঙ্গাইল শহরের মানুষের যাতায়াত কমে যাওয়ায় কমে গেছে অটোরিকশার উপস্থিতিও। এ সুযোগে টাঙ্গাইল পৌরসভা উচ্চ মহলের সঙ্গে যোগসাজসে আরো এক হাজার অটোরিকশাকে বৈধতা দেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কোনো অটোরিকশা মালিক সরাসরি নম্বর প্লেট নিতে পারবেন না। কাউন্সিলর বা তাদের সিন্ডিকেটের কোনো সদস্যদের মাধ্যমে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে সেই নম্বর প্লেট নিতে হবে। এমন অঘোষিত পন্থা চালু করা হয়েছে।

পৌরসভার একটি সূত্র জানায়, একহাজার অটোরিকশার নম্বর প্লেটের প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে পৌরসভার কয়েকজন কাউন্সিলর ও একজন প্যানেল মেয়রও রয়েছেন। আর এই প্যানেল মেয়রের মাধ্যমেই বেশিরভাগ নম্বর প্লেট বিতরণ করা হচ্ছে। আবার সহযোগীদের দিয়ে সেগুলো বিক্রি করাও হচ্ছে।

টাঙ্গাইল ট্রাফিক পুলিশের একজন সার্জেন্ট জানান, দিনদিন শহরে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি পৌর কর্তৃপক্ষ এক হাজার অটোরিকশার লাইসেন্স দিয়েছে। সেগুলো ৮০ থেকে এক লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। এখন করোনার কারণে সেই রেজিস্ট্রেশনের মূল্য ৭০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই সার্জেন্ট অসহায়ভাবে বলেন, আমাদের তো এ বিষয়ে কিছুই করার নেই। আমাদের দায়িত্ব শহর যানজটমুক্ত রাখা। কিছু বলতে গেলেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।

কাগমারী এলাকার সুনীল বলেন, আমি প্রতিদিন ৩০টি অটোরিকশার নম্বর প্লেট ভাড়া দেই। প্রতি প্লেট প্রতিদিনের ভাড়া ৮০-১০০ টাকা। আমার নিজের নামেও আছে কিছু আর বেশ কয়েকজনের প্লেট নিয়ে এসে ভাড়া দিয়ে থাকি। বর্তমানে পৌরসভার প্লেট পাওয়া খুব দুর্লভ বিষয়। পুরাতন প্লেট এক লাখ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাঙ্গাইল পৌরসভার এক কর্মচারী বলেন, সরাসরি প্লেটের জন্য গেলে পৌর কর্তৃপক্ষ তা দেবে না। পৌরসভার কাউন্সিলর বা পৌরকর্তৃপক্ষের কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে প্লেট নিতে হবে। তা না হলে বছরের পর বছর ঘুরেও প্লেট পাওয়া যাবে না। কাউন্সিলররা তাদের ভাগের প্রতি প্লেট এক লাখ থেকে শুরু করে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে।

পৌরসভার ৩৫৪৫ নম্বর প্লেটের মালিক মিলন নামের এক ব্যক্তি জানান, তার কাছে বেশ কয়েকটি নতুন ও পুরাতন লাইসেন্স রয়েছে। সেগুলো তিনি ভাড়া এবং বিক্রি করেন। তবে নতুনের চেয়ে (তিন হাজারের উপরে) পুরাতন লাইসেন্সের চাহিদা বেশি। কারণ পুরাতন লাইসেন্স (এক থেকে তিন হাজারের মধ্যে সিরিয়াল) প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে এক লাখের মধ্যে। কারণ এগুলো ডিজিটাল প্লেট। আর নতুনগুলোর দাম প্রতিটি ৬০ থেকে ৭০ হাজারের মধ্যে। কারণ এগুলো এখনো ডিজিটাল প্লেট হয়নি।

পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জোগসাজসে অতিরিক্ত এক হাজার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। যেগুলোর কোনো বৈধতা নেই। শুধু স্টিকার দিয়েই চলছে এসব অবৈধ ব্যটারি চালিত অটোরিকশা। ৩৬০১ নম্বর প্লেটের মালিক আলামিন নামের চালক জানান, তিনি গত ছয় মাস আগে এক লাখ টাকা দিয়ে ওই নম্বর প্লেটটি কিনেছেন। তবে তাকে এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নম্বর প্লেট দেয়া হয়নি। ৩২৭৭ সিরিয়ালের নম্বর প্লেটটিও আরেক চালক মোসলেম উদ্দিন প্রতিদিন ৬০ টাকা করে ভাড়া দিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন।

৩৮৯৫ সিরিয়ালের মালিক সোনা মিয়া জানান, তিনি ৯৫ হাজার টাকায় এটি একজন কাউন্সিলরের মাধ্যমে কিনেছেন। এখন তিনি এটি প্রতিদিন ৬০ টাকা করে ভাড়া দিচ্ছেন। তার কাছে আরো দুটি রয়েছে। সেগুলোও মাসিক হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে।

টাঙ্গাইল পৌরসভার সহকারী কর আদায়কারী রনজিত চন্দ্র পাল জানান, প্রতিটি অটোরিকশার লাইসেন্স নতুন নিবন্ধন করতে হলে সরকারি ফি ১০ হাজার ৫০০ টাকা এবং নবায়ন করতে ভ্যাটসহ এক হাজার ৭২৫ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শহরে কতগুলো অটোরিকশা রয়েছে এবং নতুন নিবন্ধনের জন্য সরকারি ফি’র অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন কি না এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App