×

সারাদেশ

রামগড়ে ভূমি জালিয়াতি, ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৫৭ পিএম

রামগড়ে ভূমি জালিয়াতি, ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

রামগড়ে ভূমি জালিয়াতি, ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা। ছবি: রামগড় (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি

খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় স্থলবন্দরের কার্যক্রমকে গতিশীল করতে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ এলওসি ৩ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে জাল-জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক ও বর্তমান মেয়র এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে রামগড় ভূমি অফিস। এছাড়া জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ভূমি বিভাগের তিনজন কর্মচারীকে বরখাস্ত ও অপর তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

জানা গেছে, গত ২০ সেপ্টেম্বর রামগড় বাজার থেকে সোনাইপুল টোলকেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় ১৮ একর প্রকল্প এলাকার ছয়টি হোল্ডিং বাতিল করা হয়েছে এবং জেলা প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) রামগড়ের নির্দেশে রামগড় ভূমি অফিসের অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো. কবির আহাম্মদ বাদী হয়ে ছয়টি হোল্ডিং ও সৃষ্ট ভুয়া রেকর্ড তৈরি করে সরকারি অধিগ্রহণের অর্থ আত্মসাৎ ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ৪৬৫, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ও ৩৪ পেনাল কোডে গত বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ছয়টি মামলা রুজু করা হয়। মামলা নং- ৭-১২।

ছয়টি মামলা রুজুর বিষয়টি স্বীকার করে রামগড় থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, তিনজন তদন্ত কর্মকর্তা ইতোমধ্যে এসব মামলার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, রামগড় স্থলবন্দরের কার্যক্রমকে গতিশীল করতে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য এলওসি ৩ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পে রামগড় বাজার থেকে সোনাইপুল টোলকেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় ১৮ একর ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে দেয়া নোটিশে অনেক হোল্ডিংয়ের প্রকৃত মালিককে দখলদার দেখিয়ে নোটিশ জারির পর ভূমির মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর ভূক্তভোগীদের প্রতিবাদ সংবাদ সম্মেলন, সংবাদপত্রের সংবাদ ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে লিখিতভাবে আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন করেন। এতে বিষয়টি জেলা প্রশাসকের নজরে এলে জেলা প্রশাসক তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা এবং তদন্ত কমিটির প্রধান মনজুরুল আলম বলেন, রামগড় মৌজার ১নং সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত অধিগ্রহণের প্রায় ১৮ একর ভূমির মধ্যে প্রায় ১৩ একর ভূমির ভুয়া হোল্ডিং সৃষ্টি ও অধিগ্রহণভুক্ত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত কমিটি মাসব্যাপী শুনানি শেষে ছয়টি ভুয়া হোল্ডিং যথাক্রমে ৭৭১, ৮৮৭, ৭৯৫(ক), ১১০৩, ৭৮৬ ও ৮৮৫ বাতিল করার সুপারিশ করে।

এ সুপারিশের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গত ১৪ সেপ্টেম্বর রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর মনজুরুল আলম তার দপ্তরের স্মারক নং ১৩১২ মূলে সহকারী কমিশনার ভূমিকে তার কার্যালয় এবং ২২৯ নং রামগড় মৌজার হেডম্যানের কার্যালয়ে রক্ষিত জমাবন্ধি বহিতে ছয়টি ভুয়া নোটিং হোল্ডিংস এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রাদি জরুরি ভিত্তিতে বাতিল করে তার কার্যালয়ে জানানোর নির্দেশ দেন।

মামলার এজাহারে জানা যায়, রামগড় পৌরসভার ২২৯ নং রামগড় মৌজার অধীনে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়কের সোনাইপুল থেকে রামগড় বাজার ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় রাস্তার দুইপাশের ১ নং সরকারি খাস খতিয়ানভূক্ত ২৫ দশমিক ৯১ একর ভূমি দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ছয়টি ভুয়া হোল্ডিং সৃজন করে। জালিয়াত চক্রটি ২০২১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে রামগড় উপজেলা ভূমি অফিস ও ২২৯ নং রামগড় মৌজার হেডম্যানের কার্যালয়ের জমাবন্দিতে কাটাকাটি, ঘঁষামাজা ও ওভাররাইটিং করে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা উল্লেখ করে ভুয়া হোলিংয়ে বিভিন্ন পরিমাণে ২৫ দশমিক ৯১ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয় এবং মালিকানা স্বত্বের প্রতিবেদনে ওই ভূমি সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে অধিগ্রহণভূক্ত করা হয়।

সূত্র জানায়, দায়েরকৃত ছয়টি মামলায় রামগড় পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রফিকুল আলমসহ তার অপর তিন ভাইয়ের নামে হোল্ডিং নম্বর ৭৮৬ সৃজন করে তাদের পিতার নামে বন্দোবস্ত মামলা নং ১৫৫/৬৯-৭০ উল্লেখ করে ৫ দশমিক ৩ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করেন।

আরেক মামলায় রামগড় পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. শাহজাহান (কাজী রিপন) সহ তারা সাত ভাই এক বোনের নামেও একটি হোল্ডিং নম্বর ৭৯৫ (ক) সৃজন করে তাদের পিতার নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা নম্বর-১৪৫৫/৬৭-৬৮ উল্লেখ করে এক দশমিক ৭৪ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয়।

উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাফেজ আহমেদ ভুইয়া ও তার ভাই মকবুল আহমেদ ও আহম্মদ করিমের নামে হোল্ডিং নম্বর ১১০৩ বন্দোবস্ত মামলা নম্বর ৪৭০/৭৮-৭৯ উল্লেখ করে ৩ দশমিক ৩৮ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয়। এই বন্দোবস্তের ভূমি থেকে ক্রেতা হাছিনা আক্তার, ছবুরা খাতুন ও নুরুল ইসলামের নামে নামজারি করেন ২ দশমিক ৬০ একর ভূমি। মামলায় তাদের ভাতিজা মো. মোস্তফা ভুইয়া ও তার স্ত্রী হাছিনা আক্তার, ছবুরা খাতুন ও নুরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়।

খাগড়াছড়ি স্থানীয় সরকার পরিষদের সাবেক সদস্য ভুবন মোহন ত্রিপুরার নামে ভুয়া হোল্ডিং নম্বর ৭৭১ সৃজন করে তার নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা নম্বর ৫০১৫৬/৬০-৭০ উল্লেখ করে ৬ দশমিক ৩৮ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয়। পরবর্তীতে নুরের নবী চৌধুরী, মো. মোস্তফা ভুইয়া, শাহানার আক্তার, ছবুরা খাতুন, নুরুল ইসলাম, দীলিপ চন্দ্র রক্ষিত, মো. ফেরদৌস ইসলাম, সাজেদা খাতুন, স্নেহ কান্তি চাকমা ও অবনী লাল ত্রিপুরার নামে নামজারী মামলা উল্লেখ করে ৫ দশমিক ৩৮ একর ভূমি বিক্রির ভুয়া নোটিং করা হয়। এই মামলায় ১০ ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়।

এছাড়া, ভুয়া হোল্ডিং নম্বর ৮৮৫ সৃজন করে রুহুল আমীনের নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা ১৪৩৪/৭৯-৮০ উল্লেখ করে ৪ দশমিক ৩১ একর ভূমি বন্দোবস্তের নোটিং করায় মৃত রুহুল আমীনের স্ত্রী নুর জাহান বেগম, মেয়ে রোকেয়া বেগম, জাহানার বেগম, নাজমা বেগম, রাশেদা বেগম, আছমা বেগম, জোবেদা আক্তার মুন্নি, ছেলে নুরুন নবী ও মামুন হোসেনের নামেও মামলা হয়েছে।

অপর একটি মামলার আসামি কামিনি রঞ্জন ত্রিপুরা নামে এক ব্যক্তির নামে ভুয়া হোল্ডিং নম্বর ৮৮৭ সৃজন করে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা নম্বর ১৯১৫/৬৯-৭০ উল্লেখ করে ৫ দশমিক ০৭ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয়। এই ভুয়া বন্দোবস্ত ভূমি থেকে ক্রেতা হিসেবে ছবুরা খাতুন, তার ছেলে নুরুল ইসলাম, মোস্তফা ভুইয়া, শাহানা আক্তার, মো. ফেরদৌস ইসলাম, পারভিন আক্তার, নুরের নবী চৌধুরি ও সাজেদা খাতুনের নামে নামজারি মামলা নম্বর ৫৭/রাম/৮৯ উল্লেখ করে ৫ দশমিক ৭ একর ভূমি বিক্রির ভুয়া নোটিং করা হয়। মামলায় কামিনী রঞ্জন ত্রিপুরাসহ সকলকে আসামী করা হয়।

বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মনজুরুল আলম সাংবাদিকদের আরও জানান, রামগড় ভূমি অফিস, রেকর্ড শাখা ও জেলা কানুগোসহ ছয় সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এর মধ্যে জেলা প্রশাসকের আওতাধীন তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অপর তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভাগীয় কমিশনার ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। মৌজাপ্রধানকে অপসারণ ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পার্বত্য শাসনবিধি অনুযায়ী মং সার্কেল চিফকে (রাজা) চিঠি দেয়া হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App