×

সারাদেশ

অভিনব প্রতারণায় তিস্তার চরে বেহাত শত কোটি টাকার জমি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১৫ পিএম

অভিনব প্রতারণায় তিস্তার চরে বেহাত শত কোটি টাকার জমি

অভিনব প্রতারণায় তিস্তার চরে বেহাত শত কোটির টাকার জমি। ছবি: সংগৃহীত

নীলফামারীর ডিমলার তিস্তার চরে হঠাৎ হাজির হন রংপুরের সফিয়ার রহমান ও শাহ মো. মেহেদী হাসান। তারা চরের লোকদের বলেন, তিস্তার চরে সোলার প্যানেল তৈরির কারখানা নির্মাণ করা হবে। আপনাদের কাজে নেয়া হবে এই প্রস্তাবে জমির মালিক কয়েকজন রাজি হলে ‘কোম্পানির’ কাছে জমি বিক্রির জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আমমোক্তারনামা) চান ওই দুজন।

এরপর পাওয়ার অব অ্যাটর্নির নামে কয়েকজনের কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তাদের অজান্তেই জাল দলিল তৈরি করে ২২ জুন রাতে লিখে নেয়া হয় চরের ১ হাজার ৩৯ একর জমি। এসব জমির বাজারমূল্য প্রায় শতকোটি টাকা। দলিলে ২৭ জনের স্বাক্ষর থাকলেও মূলত স্বাক্ষর দিয়েছেন ১০-১২ জন। বাকি ব্যক্তিদের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।

সম্প্রতি জমিতে চাষাবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন জানতে পারেন, পুরো তিস্তার চরের জমি এখন সফিয়ার ও মেহেদী গংদের। কৃষিজমির পাশাপাশি অনেক পরিবারের বাড়িঘরও ওই দুজনের মালিকানাধীন। এতে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে চরের প্রায় দুই হাজার পরিবার। প্রতিকার চেয়ে ডিমলা উপজেলা প্রশাসন ও নীলফামারী জেলা প্রশাসনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন জমির প্রকৃত মালিকেরা।

ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, জাল দলিল তৈরি করে এভাবে এক হাজারের বেশি একর জমি হাতিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে ডিমলার সাবরেজিস্ট্রার মনীষা রায় এবং দলিল লেখক মতিউর রহমান চৌধুরীর সহযোগিতায়। মতিউর ডিমলার দলিল লেখক সমিতির সভাপতি। ডিমলা সাব রেজিস্ট্রার মনীষা রায়ের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায়। প্রতারণা করে জমি লিখে নেয়া সফিয়ার রহমানের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ আর মেহেদীর বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। তিস্তার চর এলাকাটি পড়েছে ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ছাতুনামা মৌজায়।

ভূমি অফিস ও স্থানীয় সূত্র বলেছে, ছাতুনামা মৌজার ১ হাজার ৩৯ একর জমি গত ২২ জুন সফিয়ার রহমান ও শাহ মো. মেহেদী হাসানের নামে ডিমলা সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রিযুক্ত অপ্রত্যাহারযোগ্য আমমোক্তারনামা দলিল করা হয়। দলিল লেখক মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদনায় পাঁচটি দলিলের (দলিল নম্বর ৩২৫৯/২৩, ৩২৬০/২৩, ৩২৬১/২৩, ৩২৬২/২৩ এবং ৩২৬৩/২৩) মাধ্যমে জমি হস্তান্তর হয়। দলিলগুলোয় ডিমলা ও হাতিবান্ধা উপজেলার ২৭ জনকে বিক্রেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। জমি হাতছাড়া হওয়ার বিষয়টি গত আগস্টের মাঝামাঝি জানতে পারেন প্রকৃত মালিকেরা।

জমি হারানো স্থানীয় বাসিন্দাদের একজন মজিবর রহমান। তিনি বলেন, তিনি জমি বিক্রি করেননি। অন্য ব্যক্তিদের ভুয়া মালিক সাজিয়ে দলিল করা হয়েছে। তাদের জাল স্বাক্ষর ও ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়েছে জমির দলিলে। একই অভিযোগ করেছেন জমি হারানো অন্যরাও।

ভুক্তভোগীরা বলেন, সম্প্রতি জমি চাষ করতে গেলে তাদের বলা হয়, পুরো চরের জমি এখন সফিয়ার ও মেহেদীর। মালিকেরা তখন জানতে পারেন, তাদের অগোচরে জাল দলিলে বসতভিটাসহ ফসলি জমি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।

আমমোক্তারনামায় স্বাক্ষর করা বাহাদুর, ছফের আলী, আব্দুল লতিফ, রেজাউলসহ অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সফিয়ার ও মেহেদী তিস্তার চরে তাদের জমিতে সোলার প্যানেল কারখানা নির্মাণের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে রাজি হলে ওই দুজন জানান, কোম্পানির কাছে জমি বিক্রির আলোচনার জন্য প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দুজনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে হবে। তবে কোন কোম্পানির কাছে জমি বিক্রি হবে, তা ওই দুজন জানাননি। স্থানীয় ১০-১২ জন সশরীরে হাজির হয়ে শুধুমাত্র ‘কোম্পানির’ সঙ্গে আলোচনার জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন, তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে জমি লিখে নেয়া হয়েছে, দলিলে ইচ্ছেমতো জমির পরিমাণও বসিয়ে নেয়া হয়েছে। এমনকি যেসব জমির মালিক তারা নন, সেসব জমিও তাদের জমি বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে তারা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।

ছফের আলী বলেন, ‘জলঢাকা উপজেলায় সাব রেজিস্ট্রার মনিষা রায়ের বাড়িতে তারা আমাদের ডেকে নেন। রাত ১০টার দিকে দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। দলিলে কী লেখা হয়েছে, আমাদের না জানিয়ে স্বাক্ষর নিয়েছেন সাব রেজিস্ট্রার মনীষা। পরে জানতে পারি, আমাদের ভুয়া মালিক সাজিয়ে অন্যের জমি লিখে নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তিস্তার চরে তার মাত্র দুই একর জমি আছে।

বাহাদুর বলেন, যে পরিমাণ জমি তাদের স্বাক্ষরে লিখে নেয়া হয়েছে, এত জমির মালিক তারা নন। তারা ১০-১২ জন মিলে মোটের ওপর ১৫ একর জমির মালিক হবেন। কিন্তু দলিলে তাদের জমির পরিমাণ ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

আব্দুল লতিফ বলেন, তিনি স্বাক্ষর দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার ছোট ভাই আব্দুস সামাদ যাননি। তারপরও দলিলে তার জাল স্বাক্ষর রয়েছে। তার মতো প্রায় ১৫ জনের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। দলিলে তাদের জীবিত বাবাকে মৃত উল্লেখ করা হয়েছে।

আবদুল লতিফ আরও বলেন, তিস্তার চরে তার ১ একর ৯০ শতাংশ জমি আছে। আর তার ভাই আব্দুস সামাদের জমি আছে এক একর।

তবে মনীষা রায় অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। দলিল লেখক মতিউর রহমানের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দলিলগুলো করা হয়েছে। এখন দাতারা যদি কোনো অভিযোগ করেন, তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আর দলিল লেখক মতিউর রহমান বলেন, ‘সাব রেজিস্ট্রার কাগজপত্র দেখে দলিল রেজিস্ট্রি করেছেন। কাগজপত্র ঠিক না থাকলে জমি রেজিস্ট্রি কীভাবে হলো?’

একই কথা বলেছেন জমিগুলো কিনে নেয়া দুই ক্রেতার একজন সফিয়ার রহমানও। অভিযোগের বিষয়ে জানতে মেহেদী হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ডিমলা উপজেলায় জাল দলিলের একটি চক্র সৃষ্টি হয়েছে। এর আগেও অনেকে এ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, সাব রেজিস্ট্রার মনীষার বিরুদ্ধে এর আগেও জাল দলিলে জমি রেজিস্ট্রির অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে এ-সংক্রান্ত মামলাও হয়েছে।

এর আগে প্রতারণার শিকার হন জমি হারানো ব্যক্তিদের একজন ডিমলার খড়িবাড়ি এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, তিনি সাব রেজিস্ট্রার মনীষাকে তার জমির মূল কাগজপত্র দেখিয়ে রেজিস্ট্রি বন্ধের আবেদন করেছিলেন। বিষয়টি তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সাব রেজিস্ট্রার ভুয়া মালিক রণজিতের জাল দলিল ও নামজারি দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন।

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, জাল দলিল করে পুরো চরের জমি দখলের অভিযোগ উপজেলা প্রশাসনে জমা পড়েছে। তবে অভিযোগটি এখনো তিনি দেখতে পারেননি। তিনি সদ্য ডিমলায় যোগ দিয়েছেন। অভিযোগটি জমা পড়েছে তার আগে যিনি ইউএনও ছিলেন, তার সময়ে। অভিযোগটি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি শুনেছি। তবে অভিযোগের কপি এখনো হাতে পাইনি। কপি পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App