×

সারাদেশ

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বাগেরহাটে সেদিন যারা প্রতিবাদ করেছিল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৩, ১০:৪২ পিএম

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বাগেরহাটে সেদিন যারা প্রতিবাদ করেছিল

ছবি: সংগৃহীত

১৫ আগস্ট বাংলাদেশি বা বাঙালি জাতির জন্য একটি কালো অধ্যায়। কারণ এই দিনে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও সেই রাতে তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে তার জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমেদ, এসবির কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান ও সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককে হত্যা করা হয়।

ওই কালরাতেই বিপথগামী সেনাসদস্যদের আরেকটি দল বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগের নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকেও হত্যা করে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবি, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় আবদুল নঈম খানকেও হত্যা করা হয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থান করায় বেঁচে যান।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারা দেশের মানুষ নিশ্চুপ হয়ে যায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়েছিল। সবাই শোকে হকবিহ্বল হয়ে পরে। কারও কোন কথা বলার সাহস ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের দিন ১৬ আগস্ট সারাদেশে প্রতিবাদের পরিবর্তে কিছু মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছিল।

বাগেরহাটেও ঠিক একই অবস্থা ছিল। জেলার সর্বত্র সুনসান নিরবতা, কারও কথা বলার সাহস নেই। পরবর্তী সময়ে গুটিকয়েক লোক বাগেরহাটে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাগে প্রতিবাদ করেছিল। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ভারতে বসে প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে পোস্টার তৈরি করেছিল। সারাদেশে সেটি বিলি করার জন্য লোক নির্ধারণ করা হয়েছিল। বাগেরহাটে সেই পোস্টার বিলি করার জন্য বাগেরহাটের মোরলগঞ্জ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মোসলেম উদ্দিন, মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নকীব সিরাজুল ইসলাম, বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মীর শওকত আলী বাদশা, সাবেক সংসদ সদস্য মীর শাখাওয়াত হোসেন দারু, বাগেরহাট সদর উপজেলার সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি প্রয়াত খোন্দকার জিয়াউল ইসলাম চাঁনের নাম সবার আগে আসে।

তারা তাদের নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে বাগেরহাট ও বরিশাল বিভাগে সেই পোস্টার লাগানোর দায়িত্ব পালন করেন। পরে পোস্টার লাগানোর অপরাধে এই সব নেতাকর্মীকে বিভিন্ন সময় আটকও করা হয়েছিল।

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মোসলেম উদ্দিন যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর প্রথম, যিনি বাগেরহাটসহ পিরোজপুর, বরিশাল অঞ্চলে কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে করা পোস্টার তার মাধ্যমে ভারত থেকে এ অঞ্চলে আসে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর আমরা এ দেশে না থাকতে পেরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করি। পরে ১৯৭৬ সালে আমি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকির করা পোস্টার নিয়ে বাংলাদেশে আসি। আমি সেই সময়কার সংসদ সদস্য মীর শাখাওয়াত হোসেন দারু ও তার ছোট ভাই মীর শওকত আলী বাদশার সহযোগিতায় বাগেরহাটসহ পিরোজপুর ও বরিশালে সেই পোস্টার লাগানোর ব্যবস্থা করি। এর জন্য আমাকে জেলহাজতসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ১৯৭৫ সালে বাগেরহাট শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সরদার সেলিম আহমেদ দৈনিক ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের দিন বাগেরহাটসহ সারাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তবে সে সময় ভয়ে কেউ কথা বলেনি। আমি এবং বর্তমান মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এমদাদ হোসেন, প্রয়াত সুদর্শন মিত্র, শেখ ওহিদুজ্জামান, বীর মুক্তিযোদ্ধা নকীব সিরাজুল হক, খান ইকবাল হোসেন, খলিলুর রহমান (ছোট খলিল) বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক ভারত থেকে পাঠানো পোস্টারগুলো বাগেরহাটের বিভিন্ন অলি-গলিতে লাগানো শুরু করি।

এছাড়া এদিন এদেরকে সাথে নিয়ে বাগেরহাট রেল রোড থেকে একটি মিছিল বের করি। পরে আমার নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলাসহ ২৯টি মামলা দেয়া হয় এবং আমি গ্রেপ্তার হয়ে যাই। বিভিন্ন মামলার কারণে আমি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হই।

তিনি আরও বলেন, মামলা-হামলার পরেও মনের মধ্যে একটি শান্তি অনুভব করি, আমাদের কারনেইতো আজ আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগের নেতা শেখ ফজলুল হক মনির সাথে রাজনীতি করা বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মীর শওকত আলী বাদশা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সারাদেশের মানুষ শোকে স্তব্ধ হয়ে পরে। কারও প্রতিবাদ করার সাহস না থাকলেও মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বাগেরহাটেও ঘটেছিল। সেই সময় ভারত থেকে কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে প্রথম পোস্টার তৈরি করেছিল। আর বাগেরহাটের মোরলগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে বাগেরহাটে সেই পোস্টার বিলির দায়িত্ব আমি এবং আমার ভাই সেই সময়ের এই অঞ্চলের সংসদ সদস্য মীর শাখাওয়াত হোসেন দারু পালন করি। এমনকি বরিশাল অঞ্চলে পোস্টার বিলির জন্য আমি ডা. মোসলেম উদ্দিন ভাইকে (যিনি তৎকালীন যুবলীগের জেলা কমিটির সহ-সভাপতি) ব্যবস্থা করে দেই।

তিনি আরও বলেন, বাগেরহাটে পোস্টার লাগানোর অপরাধে পরবর্তীতে সেনাবাহিনী আমাকে গ্রেপ্তারও করেছিল।

বাগেরহাট প্রেস ক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নকীব সিরাজুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনঃগঠন করার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিল বঙ্গবন্ধু। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। সে সময় সারা দেশ শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের কোন ক্ষমতা ছিল না। ১৫ আগস্ট ১৯৭২ সালে আমরা বাগেরহাটে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম মিছিল বের করি। আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক প্রচারিত পোস্টার আমি নিজ হাতে বাগেরহাট অলি গলিতে লুকিয়ে লুকিয়ে সাটিয়ে দেই। এর কারণে বিভিন্ন সময় অমাদের বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম।

বাগেরহাটের মোরলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এমদাদ হোসেন বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার পুরো পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন। এটা শোনার পর আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি।

তিনি সেই সময়ের স্মৃতি মনে করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ছিলাম। তার মৃত্যু আমরা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারিনি। সেই সময় আমরা যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতাম তাদের উপর নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিল। নির্যাতন হয়রানি সহ্য করতে না পেরে ৩ নভেম্বর আমি ভারতে চলে যাই। সেখান থেকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর করা পোস্টার নিয়ে আমি বাগেরহাটে আসি এবং মোরেলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন যায়গায় বিতরণের ব্যবস্থ্যা করি।

তিনি আরও বলেন, সেই সময় আমি ১৫ মামলার শিকার হয়েছিলাম। পরে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়। এমনকি খুনিদের দেশের বাইরে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর খুনিদের বিচার শুরু হয়। একই সঙ্গে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ও এই দিনে সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App