×

সারাদেশ

চট্টগ্রামে বন্যায় ১৩৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১০:৩৬ পিএম

চট্টগ্রামে বন্যায় ১৩৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি
  • ২৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল
  • সাড়ে ১৩ হাজার পুকুর-ঘের প্লাবিত

টানা ভারী বৃষ্টি ও নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রামে আউশ-আমনের ফলন, সবজির আবাদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীসহ ১৩টি উপজেলায় এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৩৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা বলে ধারণা করছে চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য অধিদপ্তর। বন্যার পানিতে ডুবে চট্টগ্রামে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ১৪টি উপজেলা এবং সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার ১২টি পারিবারের ছয় লাখ ৩৫ হাজার ১৩০ জন লোক বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েন। এর মধ্যে কেবল সিটি কর্পোরেশনে ৮০০ পরিবারের চার হাজার জন পানিবন্দি ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় বন্যায় প্রাথমিকভাবে ১৩৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছে। তবে এটিকে একেবারে প্রাথমিক ধারণা বলছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার। তিনি বলেন, জেলার সন্দ্বীপ ছাড়া বাকি ১৪ উপজেলায় কমবেশি বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী। আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারছি না। ১৩৫ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটি একেবারে প্রাথমিকভাবে করা হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে বিভিন্ন সংস্থা রিপোর্ট দেবে, যার জন্য অন্তত একমাস সময়ের প্রয়োজন। পরিস্থিতি দেখে আশঙ্কা করছি প্রকৃতক্ষতির পরিমাণ আমাদের অনুমানকে ছাড়িয়ে যাবে।

গত ১ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ৪ আগস্ট নগরী ও জেলায় বন্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চারদিন টানা জলাবদ্ধতা ছিল নগরীতে। গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামে ৬৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা বিগত ৩০ বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। অতি বৃষ্টির সাথে যোগ হয়েছে পাহাড়ি ঢল। পাহাড়ি নদী সাঙ্গু, মাতামুহুরী ডলু এবং কর্ণফুলী ও হালদার পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হয়। জেলার ১৫ উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলায় এখনও কিছু কিছু এলাকায় বন্যায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। জেলার সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলায় এখনও হাজার হাজার বাড়িঘর পানির নিচে ডুবে ছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলায়।

এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাছচাষীরা। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রাম মহানগরীসহ ১৩টি উপজেলার ১৩ হাজার ৩৭৯টি পুকুর, দিঘী ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। এরমধ্যে ১৮৯ হেক্টর আয়তনের ১২৬টি মাছের ঘেরের সবকটি শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবকাঠামোসহ সব মিলিয়ে বন্যায় মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ৭৫ কোটি টাকা। বন্যার পানিতে ৪ হাজার ১৫৪ মেট্রিকটন রুই, কাতল, মৃগেল, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস জাতীয় মাছ এবং ১৮৫ লাখ ৩৫ হাজার পোনা মাছ ভেসে গেছে। জেলা মৎস্য অফিসের জরিপ কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, জেলার ১৫ উপজেলার মধ্যে সীতাকুন্ড এবং ফটিকছড়ি উপজেলায় মৎস্যখাতে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। জেলার বাকি সব উপজেলা এবং মহানগরীতে মৎস্য চাষে অনেক ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় অনেক পুকুর ও মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলায়। জেলায় মাছ চাষ করা হয় এমন জলাশয় আছে ১৮ হাজারের বেশি। বন্যায় প্রায় ৭৪ শতাংশ পুকুর, দিঘী ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। ফলে রুই জাতীয় মাছ চাষীদের প্রায় ৪৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া, পোনায় ৬৭০ লাখ ও চিংড়িতে ক্ষতি হয়েছে ৩৮০ লাখ টাকার। অবকাঠমোসহ সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৭৫ কোটি টাকার বেশি। শুধু মৎস্য খাতেই ৬৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট মাস হলো চাষীদের মাছ তোলার পিক টাইম। আগামী মাস থেকে পুকুরে নতুন করে পোনা ছাড়ার কথা। এ অবস্থায় বন্যা হওয়ায় মাছচাষী ও পোনাচাষী উভয়েই বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়েছেন। স›দ্বীপ ছাড়া বাকি ১৪ উপজেলার মৎস্য খাত পুরোপুরি শূন্যে পৌঁছে গেছে। পাশাপাশি ১৫ জেলে আহত ও জেলেদের ৭৮টি মাছধরার নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সাতকানিয়া এলাকার এক তরুণ উদ্যোক্তা দিদারুল ইসলাম বলেন, দেড় সপ্তাহ আগেও পুকুর ভরা মাছ, সবজি ক্ষেত ও খামার ভর্তি ব্রয়লার মুরগি ছিল আমার। এখন আর কিছুই নেই। বন্যার পানিতে আমার সবই শেষ হয়ে গেছে। চন্দনাইশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান আহসানুল কবির বলেন, এই উপজেলায় বন্যায় দুই হাজার ৫৩৭টি পুকারের মাছ ভেসে গেছে। এরমধ্যে ১০ লাখ মাছের পোনাও আছে। অবকাঠামোসহ প্রাথমিকভাবে এ উপজেলায় মৎস্য খাতে ক্ষতি দুই কোটি টাকা। তবে এই ক্ষতি আরো বাড়তে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগর ও ১৫ উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ হাজার হেক্টর আমন ফসল, চার হাজার ৫০০ হেক্টর আউশ ফসল, তিন হাজার ৭০০ হেক্টর আমনের বীজতলা ও পাঁচ হাজার ১০০ হেক্টর সবজির আবাদ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরের পাঁচলাইশ, ডবলমুরিং ও পতেঙ্গা এলাকার শরৎকালীন সবজিসহ পাঁচ হেক্টর জমির আউশ, ২০ হেক্টর জমির আমনের বীজতলা ও ১৪০ হেক্টর জমিতে লাগানো সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। বাদবাকি ক্ষতি হয়েছে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়াসহ ১৪ উপজেলায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এক মাস আগে চট্টগ্রাম মহানগর ও উপজেলা মিলে নয় হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিন হাজার ৮৪৬ হেক্টর জমিতে লাগানো বীজতলা পানিতে ডুবে গেছে। গতমাসের শেষের দিকে চট্টগ্রাম মহানগর ও উপজেলা মিলিয়ে ৫১ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে লাগানো হয়েছিল আমনের চারা। ভারী বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বর্তমানে ১৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে লাগানো আমনের চারা পানিতে ডুবে গেছে। ভারী বর্ষণ ও বন্যায় চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, বাঁশখালী, আনোয়ারা, স›দ্বীপ ও সাতকানিয়া এলাকায় আবাদ করা আউশ ধানের বেশি ক্ষতি হয়েছে। চলতি মাসের শেষের দিকে এসব ফসল কাটার কথা ছিল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, লোহাগাড়া, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, পটিয়া, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী এলাকায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। এসব এলাকায় উৎপাদিত আউশ ধান ও সম্প্রতি লাগানো আমনের চারা পানিতে ডুবে গেছে। পাশাপাশি সবজির আবাদ পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আশা করছি, বীজতলা থেকে পানি সরে যাওয়ার পর সেগুলোর সঠিক পরিচর্যা করলে আমনের আবাদ থেকে ভালো ফসল পাওয়া যাবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান বলেন, কৃষি জমিগুলো থেকে এখনো পুরোপুরি বন্যার পানি নামেনি। ৫ হাজার ১০০ হেক্টর সবজির পুরোটাই একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া আউশ ফসলের ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারন করেছে। চলতি মাসের শেষের দিকে এসব ফসল কাটার কথা ছিল। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে কৃষির ক্ষতির পরিমাণ ৭০-৮০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

এদিকে জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় চট্টগ্রামের নয়টি উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৮ কোটি টাকা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮৫টি গবাদি পশুর ও ২৬৫টি হাঁস-মুরগির খামার। এছাড়া, নষ্ট হয়েছে ৯৩ মেট্রিক টন দানাদার খাবার, ৬৭ মেট্রিক টন শুকনো খড় ও ২৬২ মেট্রিকটন ঘাস। এতে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আকস্মিকভাবে বন্যা হওয়ায় খামারিরা একেবারে প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকে গরু-ছাগল উঁচু জায়গায় নিয়ে যেতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছেন। হাঁস-মুরগি সরিয়ে নেয়ার সুযোগ তেমন ছিল না, তাই ক্ষতি বেশি হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত শুধু খামার গুলোর ক্ষয়ক্ষতির খবর পেয়েছি। এর বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে গবাদি পশু লালন-পালন করেন, সেসব ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে আমরা এখনো জানি না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App