×

সারাদেশ

চট্টগ্রামে পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩০ পিএম

চট্টগ্রামে পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ

চট্টগ্রামে পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ। ছবি: চট্টগ্রাম অফিস

চট্টগ্রামে পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ
টানা বর্ষণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলা কয়েক লাখ মানুষ। বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি, তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত, চিংড়ি ঘের ও পুকুর। বিভিন্নস্থানে উপড়ে পড়েছে বড় বড় গাছ। প্রায় সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও অঘোষিত বন্ধ রয়েছে। বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সাময়িক বন্ধ রাখতে হচ্ছে। পানিতে তলিয়ে গেছে অধিকাংশ রাস্তাঘাট। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে এলাকার মানুষের। বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধসের শঙ্কায় বাসিন্দাদের সরে যেতে মাইকিং করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জেলা প্রশাসনের কমকর্তারা। গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে চট্টগ্রাম নগরীসহ আশপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শনিবার রাত থেকে শুরু হয় অতি ভারী বর্ষণ। চারদিনের টানা বর্ষণে সাতকানিয়া, বাঁশখালী, চন্দনাইশ, হাটহাজারী, সাতকানিয়া, বোয়ালখালী এবং রাউজান উপজেলার নিচু এলাকায় লোকালয়ে পানি উঠে গেছে। এতে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এসব উপজেলার পাশাপাশি বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়ায় ফসলের ক্ষেত ও পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বীজতলা ও নতুন রোপণ করা ধানের চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি পুকুর থেকে মাছও চলে গেছে। জানা গেছে, হাটহাজারী উপজেলার মন্দাকিনী, পূর্ব ফরহাদাবাদ, উত্তর বুড়িশ্চর, সেকান্দর পাড়া, পূর্ব ধলই, মাইজপাড়া, পূর্ব এনায়েতপুর, মনোহর পাড়া, উত্তর ছাদেক নগর, গুমানমর্দ্দন পাড়া, কাটাখালীর কুল, মাস্টার পাড়া, রুদ্রপুর, কাজিরখীল, মোহাম্মদপুর, মীরেরখীল, কদলবাড়ী, মোজাফফরপুর, ভাগিরঘোনা, রহিমপুর, ইছাপুর, পূর্ব মেখল, ভবানীপুর, উত্তর মার্দাশা, মাদারীপোল, সাইনবোর্ড, খলিপারঘোনা, বাথুয়া, কুয়াইশ, বুড়িশ্চর, মধ্যম মার্দাসা গড়দুয়ারা, লোহারপোল, শিকারপুর, খন্দকিয়া, নাঙ্গলমোড়া, কুমারীকুল, সিকদারপাড়া, চারিয়া (আংশিক), মধুরঘোনা, আনন্দ বাজার, দক্ষিণ মেখল, পূর্ব ফতেপুর, মেহেরনেগা, মাছুয়াঘোনা প্রভৃতি এলাকার ৪০টি গ্রামের দুই লক্ষাধিক লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ওপরের অংশ থেকে ঢলের পানি কমলেও নিচু এলাকার বন্যা পরিস্থিতির ক্রমে অবনতি হচ্ছে। দক্ষিণ হাটহাজারীর শিকারপুর ও বুড়িশ্চর এলাকার কৃষ্ণখালী ও কুয়াইশ খাল দীর্ঘদিন সংস্কার ও খনন না করায় এই দুই ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়ক ও রাস্তাঘাট, এমনকি বসতঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। রাউজান উপজেলার উরকিরচর, পশ্চিম গুজরা, নোয়াপাড়া, বাগোয়ান, পূর্বগুজরা, বিনাজুরী ইউনিয়নের রাস্তাঘাটের ওপর দিয়ে তীব্র ভাবে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কোনো কোনো রাস্তা হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে। হালদা ও কর্ণফুলীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে মানুষের বাড়ি-ঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ হাট বাজারের দোকানগুলো হাঁটুপানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। অনেকে ঘরে চলছে না রান্না। গৃহপালিত পশু নিয়ে পড়তে হয়েছে চরম দুর্ভোগে। বোয়ালখালীর উপজেলার সারোয়াতলী, শাকপুরা, আমুচিয়া, পোপাদিয়ার বিস্তির্ণ ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। অধিকাংশ এলাকায় পুকুরের মাছ চাষীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া বোয়ালখালী উপজেলায় পানিতে কালুরঘাট ফেরির অ্যাপ্রোচ সড়ক, পল্টুন ও বেইলি সেতু ডুবে থাকায় পারাপার ব্যাহত হচ্ছে। তবে এ সময় সেতুর ওপর দিয়ে পায়ে হাঁটার সুযোগ পাওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে লোকজন। সকাল থেকেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পানি ঢুকে পড়ায় সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের। জানা গেছে, পাহাড়ি ঢলে চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকটি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সেখানে প্রায় শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। কাঞ্চনাবাদসহ আরও কয়েকটি গ্রামে ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। চন্দনাইশ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা জিমরান মোহাম্মদ সায়েক বলেন, উপজেলার বেশ কিছু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছি। দুই/তিনটি ইউনিয়নে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অনেকে বসবাস করছেন। তাদের সরে যাবার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। যারা সরে যাচ্ছেন না তাদের জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।’ চট্টগ্রামে পানিবন্দি, কয়েক লাখ মানুষ চন্দনাইশ থানা পুলিশের এক বিজ্ঞপ্তিতে উপজেলার শঙ্খ নদীসহ বিভিন্ন খালপাড়ে এবং বিভিন্ন পাহাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরে যাবার অনুরোধ করা হয়েছে। অতিবর্ষণে গাছ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বৈদ্যুতিক তারে হাত না দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে থানার ডিউটি অফিসারের (০১৩২০১০৭৮৯১) সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বলা হয়েছে। এদিকে সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ও আমিলাইষ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ও ফসলের ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাঞ্চনা, এওচিয়া, বাজালিয়া ইউনিয়নে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী শতাধিক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হলেও সড়ক যোগাযোগ ঠিক আছে। পাহাড় থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা মিলে অনেক পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে। তারা আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে গেছে।’ অন্যদিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শস্যভাণ্ডার খ্যাত গুমাই বিল পানিতে তলিয়ে গেছে। আশপাশের বীজতলা, ফসলের ক্ষেতও প্লাবিত হয়েছে। রাঙ্গুনিয়ার ইউএনও আতাউল গণি ওসমানী বলেন, লোকালয়ে এখনও পানি আসেনি। তবে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বেশি শঙ্কায় আছি পাহাড়ি ঢল নিয়ে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অনেককে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ও সাধনপুর ইউনিয়নের সাগরসংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সেখানে বিস্তির্ণ এলাকায় এবং পাহাড়ে ফসল ও সবজিক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁশখালীর ইউএনও সাইদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তিনটি ইউনিয়নের শতাধিক পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় বীজতলা ও নতুন রোপণ করা চারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাধনপুরে দেয়াল ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। স›দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সম্রাট খীসা বলেন, জোয়ারের পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এখন বেশিরভাগ বীজতলা, সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। কিছু কিছু জমিতে চারা রোপণ করা হয়েছে, সেগুলো পানিতে ডুবে আছে। এছাড়া সাগরে, নদীতে জোয়ার বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টির কারণে ফতেয়াবাদ এলাকায় রেললাইন ডুবে গেছে। সোমবার (৭ আগস্ট) সকাল থেকে বন্ধ ছিল চট্টগ্রাম নাজিরহাট ও বিশ্ববিদ্যালয় রেল যোগাযোগ। সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় শহর থেকে একটি ডেমু ট্রেন ছেড়ে আসলেও ফতেয়াবাদ রেল স্টেশন সংলগ্ন রেললাইন ডুবে যাওয়ার কারণে আটকা পড়ে। স্থানীয়রা জানান, টানা বর্ষণের কারণে ফতেয়াবাদের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাজিরহাট যাওয়ার রেললাইন হাঁটু পরিমাণ পানিতে ডুবে যায়। রেললাইনের ওপর দিয়ে বয়ে যায় পানির ঢল। ফতেয়াবাদ রেল স্টেশনের কাছেই আটকে ছিল ডেমু ট্রেন।রেললাইনেও পানি জমে যাওয়া সকাল থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। পরে রেলওয়ের কর্মীরা পানি চলাচলের রাস্তা তৈরি করা হয়। বিকেলের পর ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আবহাওয়া অফিস অতি ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির অবনতি ও পাহাড়ধসের সতর্কতা জারি করে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস গতকাল সোমবার (৭ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সেমবার (৭ আগস্ট) ভোর ৬টা পর্যন্ত ৩২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা গত ৩০ বছরে রেকর্ড। রোববার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টায় পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল জানান, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণে অতি ভারী বৃষ্টিপাত মঙ্গলবারও অব্যাহত থাকবে। এর প্রভাবে পাহাড় ধ্বসেরও সম্ভাবনা রয়েছে। ৯ আগস্ট থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে পারে। সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত এবং নদীবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে পাহাড় ধসের পূর্বাভাস। আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক স্বাক্ষরিত বার্তায় জানানো হয়, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘন্টায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিমি) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিমি বা তারও বেশি) বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ী এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধ্বসের সম্ভাবনা রয়েছে।’ জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, মানুষের জানমাল রক্ষার্থে চট্টগ্রাম মহানগরে ৬টি সার্কেলের মাধ্যমে ভাগ করে পাহাড় রক্ষা এবং মানুষের জানমাল রক্ষায় জেলা প্রশাসনের কয়েকটি টিম কাজ করছে। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় প্রতিদিন মাইকিং থেকে শুরু করে মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরে যেতে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App