×

সারাদেশ

হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাড়ে ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৭:১৭ পিএম

হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাড়ে ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ

করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন। ছবি: ভোরের কাগজ

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ১ নম্বর করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়নের বিরুদ্ধে সরকারের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৪০ দিনের কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন পর্যায়ের চার শতাধিক হতদরিদ্র শ্রমিকের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

গত ৫ বছরে এই অর্থ আত্মসাত করা হয়। চেয়ারম্যান ছাড়াও এ ঘটনার সঙ্গে পরিষদের সচিব আজম উদ্দিন ও কয়েকজন মেম্বারও জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটি বর্তমানে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। পাশাপাশি তদন্ত চালায় জেলা প্রশাসন। তবে ইউপি চেয়ারম্যান অভিযোগটি অস্বীকার করলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঘটনা স্থানীয় সরকার বিভাগের হরিলুটের আরেকটি দৃষ্টান্ত।

জানা যায়, মিরসরাই উপজেলার এক নম্বর করেরহাট ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. মোস্তফা মারা যান ২০২০ সালের ১৯ জুলাই। অথচ কবর থেকে উঠে এসে শ্রমিকের কাজ করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেছেন। জানেন না তার আত্মীয়-স্বজনেরা। একইভাবে ওই ইউনিয়নের আরেক বাসিন্দা লিটন মিয়া ২০১৭ সাল থেকে প্রবাসে বসবাস করছেন। তার নামেও নিয়মিত প্রতি বছর টাকা তোলা হচ্ছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে। তিনিও জানেন না বিষয়টি।

ঠিক একই পদ্ধতিতে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত প্রতিবন্ধী মো. হারুনের নামেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতি বছর টাকা উঠছে। কিন্তু তিনি জানেন না। শুধু এই তিনজনই নয়, এমন আরো বেশ কয়েকজন মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসী ছাড়াও ৪২০ জন ভুয়া শ্রমিকের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় অনুসন্ধান-তদন্ত শেষে সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

জানা যায়, এ ঘটনায় শুধু চেয়ারম্যান একা নয়, ইউপির সচিব ও দুই-তিনজন মেম্বারও জড়িত রয়েছে। তবে কয়েকজন মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সত্য ঘটনা বলতে গেলেও আমাদের সমস্যা হবে। কারণ আপনারাও বুঝেন, আমাদের চেয়ারম্যানের কাছে যেতে হয়, বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চেয়ারম্যানের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। একসঙ্গে কাজ করতে হয়। ফলে আমরা জেনেও প্রতিবাদ করতে পারছি না। এটা আমাদের ব্যর্থতা বলতে পারেন।

একইভাবে ভুক্তভোগীরাও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী ভোরের কাগজকে বলেন, ঘটনা এক’শ ভাগ সত্য। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের ক্ষতি করবেন না। বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলতে চাই না। কারণ আমাদের তো এলাকায় থাকতে হবে।

জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকারের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৪০ দিনের কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন পর্যায়ের চার শতাধিক শ্রমিকের ৫ বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে মর্মে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ একটি অভিযোগ জমা দেন আবু সাইদ চৌধুরী নামে স্থানীয় একজন বাসিন্দা। তিনি করেরহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে অভিযোগকারীকে অভিযোগের রেকর্ডপত্রসহ দুদক কার্যালয়ে ডাকা হয়। একইভাবে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই চেয়ারম্যানকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনায় অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান শেষে খুব শিগগিরই কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।

এদিকে, এ ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়েও একটি অভিযোগ জমা পড়ে গত বছরের ৯ মে। করেরহাট ইউনিয়নের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি এই অভিযোগপত্র জমা দেন। এরপর ওই বছরের ১৮ মে অভিযোগটি আমলে নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনও) বিষয়টি সরেজমিন তদন্তপূর্বক জরুরি ভিত্তিতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিনহাজুর রহমান তদন্ত শেষে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেন।

প্রতিবেদনে অনিয়মের কোনো তথ্যপ্রমাণ পাননি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে এই প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমি নতুন এসেছি। বিষয়টি শুনেছি। এ বিষয়ে ইউএনও’র জমা দেয়া প্রতিবেদন এখনো আমার কাছে আসেনি। প্রতিবেদন দেখে পরবর্তী করণীয় জানাতে পারব।

অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন ভোরের কাগজকে বলেন, অভিযোগ সত্যা নয়। শ্রমিকরাই তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেছেন। একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য কারো টাকা তোলার সুযোগ কোথায়?। উপজেলা নির্বাহী অফিসার তদন্ত করে কোনো তথ্যপ্রমাণ পায়নি। বর্তমানে দুদক অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানে এসে তারা সব দেখেছে। আমার উন্নয়নমূলক ও সামাজিক সেবামূলক কাজ দেখে প্রতিহিংসা থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাই বিভিন্ন দপ্তরে ভুয়া অভিযোগ দিয়ে আমাকে হয়রানি করার চেষ্টা করছে। সামাজিকভাবে আমাকে হেয় করা, মানসম্মান নষ্ট করার চিন্তা থেকেই এগুলো করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৭ সাল থেকে ভূমিহীন দরিদ্র নারী-পুরুষের জীবনমান উন্নয়নে অতিদরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান নামে বছরে ৪০ দিনের বিশেষ প্রকল্প চালু করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। যা দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App