×

সারাদেশ

মিতু হত্যা: ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন বাবুলের বন্ধু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৩, ০৫:৫২ পিএম

মিতু হত্যা: ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন বাবুলের বন্ধু

মাহমুদা খানম মিতু হত্যায় মামলায় সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল ইসলামের কর্মচারী মোখলেসুর রহমান ইরাদ আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যে তিনি জানিয়েছেন, মিতু হত্যার কয়েকদিন পর সাইফুলের নির্দেশে তিনি ‘কিলিং মিশনে অংশ নেয়া’ ওয়াসিম ও আনোয়ারের বিকাশ নম্বরে তিন লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন।

মঙ্গলবার (১৭ জুলাই) চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে ইরাদ সাক্ষ্য দেন। এসময় কাঠগড়ায় থাকা মামলার আসামি বাবুল আক্তারকে শনাক্ত করেন তিনি। মোখলেসুর রহমান ইরাদ (৩২) পাবনা জেলার ঈশ্বরদী পৌরসভার মধ্যম শরণখোলা গ্রামের বাসিন্দা।

আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে ইরাদ জানান, তিনি ২০১৪-২০১৭ সাল পর্যন্ত বাবুল আক্তারের বন্ধু সাইফুল ইসলামের কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলায় র‌্যাব অফিসের বিপরীতে ‘মাল্টিয়ান প্রিন্ট অ্যান্ড প্যাকেজিং’ নামের প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে ছিলেন। সাইফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।

বাবুল ও সাইফুলের ঘনিষ্ঠতার তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, বাবুলের পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতির খবর পেয়ে ২০১৬ সালের ৫ মে সাইফুল ইসলাম তাকে তিন হাজার টাকা মিষ্টি কেনার জন্য দেন এবং বাবুল আক্তারকে কল দিয়ে তিনি যেখানে বলেন সেখানে দিয়ে আসতে বলেন। ছয় কেজি মিষ্টি কিনে ইরাদ দুই কেজি করে তিনটি প্যাকেট করেন ইরাদ। এরপর বাবুল আক্তারকে কল দিয়ে তার কথামতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের পাশে ভগ্নিপতি আবুল কালাম আজাদের বাসায় আসেন।

এরপর মিতু হত্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ইরাদ বলেন, ‘মিতু ভাবি মার্ডার হন ২০১৬ সালের ৫ জুন। এর দুইদিন পর সাইফুল স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের শ্বশুরবাড়ি ঢাকার বনশ্রীর মেরাদিয়াতে যান। সেখানে সারাদিন অবস্থান করে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করি। বিকেল পর্যন্ত থাকি। বাবুল আক্তার স্যারের ছেলেমেয়ের সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করি।’ ‘বিকেল তিনটার দিকে সাইফুল স্যার আমাকে অফিসে যেতে বলেন। আমি বছিলায় অফিসে গিয়ে অ্যাকাউন্টসের মামুন স্যারের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা গ্রহণ করি। টাকা নিয়ে আমি সাইফুল স্যারকে কল দিয়ে টাকাগুলো কি করবো জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, তুমি মিষ্টি নিয়ে বাবুল আক্তারের বোনের বাসায় গেছিলে যেখানে, সেখানে দিয়ে আস। আমি সেখানে টাকা দিয়ে এসে রাত ১০টায় সাইফুল স্যারকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ওইদিনের কাজ শেষ করি।’

ইরাদ আরো বলেন, ‘পরদিন বিকেল ৫টা, সাড়ে ৫টার দিকে এমডি স্যার (সাইফুল) আমাকে আবারো কল দিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন নামে একজনের নম্বর দেন এবং বাবুল আক্তার স্যারের বোনের বাসায় গিয়ে তার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিতে বলেন। আমি যখন টাকাটা রিসিভ করি, তখন বাবুল আক্তার স্যারের বাবাও সেখানে ছিলেন। টাকার সঙ্গে আমাকে দুটি গ্রামীণ ফোনের মোবাইল নম্বর ও নাম দেয়া হয়, আনোয়ার এবং ওয়াসিম। টাকা পেয়ে আমি আবার সাইফুল স্যারকে ফোন করি। তিনি ওই দুটি বিকাশ নম্বরে তিন লাখ টাকা পাঠাতে বলেন।’

‘টাকা নিয়ে বাবুল আক্তার স্যারের বোনের বাসা থেকে নেমে আসার পর উনার বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কোথায় যাচ্ছি ? আমি তাকে বিকাশে টাকা পাঠাতে যাচ্ছি বলে জানাই। তিনিও আমার সঙ্গে যাবেন বললেন, সম্ভবত পান খেতে। পরবর্তীতে স্যারের বাবা ও আমি মোটর সাইকেল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাউসুল আজম মার্কেটের নিচতলায় যায়। আমি ভেতরে বিকাশের দোকানে যায়। বাবুল আক্তার স্যারের বাবা বাইরে ছিলেন’ - ইরাদ

বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠানোর তথ্য দিয়ে ইরাদ বলেন, ‘আমি ওই দোকান থেকে দুই লাখ ৩০ বা ৪০ হাজার টাকার মতো সেন্ড করতে পারি। তারপর আমি বাবুল আক্তার স্যারের বাবাকে বাসায় দিয়ে অফিসে চলে যাই। এরপর আমি সাইফুল স্যারকে কল দিয়ে বলি যে, ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, বাকি টাকা যেখান থেকে পার পাঠিয়ে দাও। পরে আমি মোহাম্মদপুর বছিলায় র‍্যাব অফিসের পাশে রিপন টেলিকম থেকে বাকি ৭০ হাজার টাকার মতো পাঠাই।’

এরপর ২০২১ সালে পিবিআই তাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও যে মোবাইলে বাবুল আক্তারের ছেলেমেয়ের সঙ্গে তার ছবি ছিল সেটি জব্দ করে এবং পরে আদালতে জবানবন্দি দেন মর্মে ইরাদ সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য দেয়ার পর ইরাদকে জেরা শুরু করেন বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন।

প্রসঙ্গত. ২০২১ সালের ২৫ মে মোখলেসুর রহমান ইরাদ চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এরপর পিবিআই জানিয়েছিল, বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ঠজনের জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের পর টাকা লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ পেয়ে পিবিআই নিশ্চিত হয়েছে যে, মিতুকে হত্যার জন্যই মূলত এই তিন লাখ টাকার লেনদেন হয়। বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় এটি ছিল একটি ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’। মূলত বাবুল আক্তারই টাকা পাঠানোর জন্য সাইফুলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

পিবিআই, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান সেদিন বলেছিলেন, ‘সাইফুল হকের মাধ্যমে বাবুল আক্তারই তিন লাখ টাকা পাঠায়। সাইফুল মুসার আত্মীয় মামুনের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুসার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিকাশের মাধ্যমে এই টাকা লেনদেন হয়েছে। বিকাশের লেনদেনের স্লিপ আমরা উদ্ধার করেছি। আমরা তদন্তে এটা নিশ্চিত হয়েছি যে, হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার তার পূর্বের কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) অনুযায়ী টাকাগুলো মুসার কাছে পাঠিয়েছে।’

এদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মহানগর পিপি আব্দুর রশীদ জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সাক্ষী সরোয়ার আলমকে জেরা শেষ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। এরপর ইরাদ সাক্ষ্য দেন। বাবুল আক্তারের বান্ধবী হিসেবে আলোচিত কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারীর বাসার প্রহরী সরোয়ার আলম সোমবার আদালতে সাক্ষ্য দেন।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সাতজনকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। ১০ অক্টোবর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। চলতি বছরের ১৩ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ৯ এপ্রিল থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্য দেন।

অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি করা হয়েছে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে। অভিযোগপত্রে আরও যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া। আসামিদের মধ্যে শুধু মুসা পলাতক আছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App