×

সারাদেশ

বন্যার অবনতি উত্তরাঞ্চলে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৩, ০৮:৪১ এএম

বন্যার অবনতি উত্তরাঞ্চলে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি
কুড়িগ্রামে ধরলা ও দুধকুমার এবং লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে তিস্তা নদীর পানি আরো বাড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে উত্তরাঞ্চলে। এ তিন জেলায় দেড় লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কাঁচা পাকা বিভিন্ন সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এদিকে সুনামগঞ্জে রাতে ও সকালে পানি বাড়লেও রোদ উঠলেই তা কমে যাচ্ছে। তবে জেলার ৬ উপজেলার নিম্নাঞ্চল এখনো প্লাবিত অবস্থায় রয়েছে।এতে কোথাও কোথাও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট- তৈয়বুর রহমান, কুড়িগ্রাম থেকে : কুড়িগ্রামে নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। দুধকুমার নদীর পর এবার ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় নদী অববাহিকার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুধকুমার নদীর পানি দশমিক ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ধরলা নদীর পানি ৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও ধরলানদীর পানি শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামীতে এসব নদ নদীর পানিও বিপৎসীমা অতিক্রম করবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছে। এসব নদনদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কাঁচা পাকা বিভিন্ন সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে দুধকুমার নদের বাঁধ উপচে প্রায় ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের সিতাইঝাড় এলাকার আইয়ুব আলী, মহব্বত ও আক্কাস আলী বলেন, হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধির কারণে ঘর বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। বাড়িতে থাকার মতো পরিবেশ নাই। উঁচু স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছি। খুব একটা বৃষ্টি নাই, ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি এত পানি হবে নদীতে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, কুড়িগ্রামে দুধকুমারের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার, ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার ও তালুকশিমুল বাড়ি পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পবাহিত হচ্ছে। নদনদীর পানি আরো কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানান তিনি। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাঈদুল আরীফ জানান, চিলমারী, উলিপুর,কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী, রাজারহাট ও ভুরুঙ্গামারীসহ বন্যায় যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে এসব এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম আজ থেকে শুরু হয়েছে। গতকাল ৬০০ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হবে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে বলে জানান তিনি। স্বপন কুমার দে, হাতিবান্ধা (লালমনিরহাট) থেকে : কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পাহাড়ি ঢল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার তিস্তা নদীর গজলডোবা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেয়ায় গতকাল শুক্রবার সকালে দোয়ানী তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ওই সময় অস্বাভাবিক পানি বেড়ে যাওয়ায় বন্যায় লালমনিরহাটৈর হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার প্রায় ২০টি ইউনিয়নের ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে গেছে । গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়ছে মানুষ। পানির চাপ কমাতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া বিভাগের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (পাউবো)। এদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা বাঁধের আশেপাশে রেডএলার্ট জারি করেছে। তিস্তার পানিতে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী, সিন্দুর্ণা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ি, সিঙ্গিমারী ও সানিয়াজান ইউনিয়ন পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর গোকুন্ডা ইউনিয়নের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধির কারণে নদী বেষ্টিত নিম্নাঞ্চলগুলো ও চরাঞ্চলে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। (পাউবো) ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদৌলা বলেন, উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বৃহস্পতিবার রাত থেকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শুক্রবার তিস্তার পানি কমে দুপুর ১২ টায় ১৭ সেন্টিমিটার ও বিকাল ৩টায় ৭ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে গড্ডিমারী ইউনিয়নের পানিবন্দি লোকদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজির হোসেন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন গড্ডিমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক শ্যামল। সরোয়ার জাহান সোহাগ, ডিমলা (নীলফামারী) থেকে : পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, বুড়ি তিস্তা ও সানিয়াজান তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২০টি গ্রামের মানুষ। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, ভারত থেকে আসা উজানের ঢলের প্রভাবে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এইসব স্থানে বসবাসরত লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। ডিমলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেজবাহুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে দুই লাখ টাকা, ৪০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ২০ টন চাল বন্যাকবলিত মানুষদের জন্য মজুত রাখা হয়েছে। মো. সাজ্জাদ হোসেন শাহ্, সুনামগঞ্জ থেকে : হাওড়ের জেলা সুনামগঞ্জে রাতে ও সকালে বৃষ্টি আর উজানের ঢলে বাড়ে পানি। আবার সকাল গড়িয়ে বেলা বাড়ার সঙ্গে রোদ উঠলেই কমছে পানি। এদিকে ভারি বৃষ্টি ও উজানের ঢলে জেলার সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুরের কিছু আংশ, দোয়াবাজার, ছাতক, ধর্মপাশা, মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গেছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে। পানি বাড়ার কারণে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। গতকাল শুক্রবার বিকালে সরজমিন ইউনিয়নের লালপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির উঠোন পর্যন্ত পানি উঠায় টিউবওয়েল থেকে পানি নেয়া যাচ্ছে না। নৌকায় করে অনেকগুলো কলসি নিয়ে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষকে অন্য গ্রাম থেকে পানি নিতে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে জেলায় ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামা কমেছে। ফলে জেলার প্রধান নদী সুরমার পানি কোথাও কোথাও কমেছে, আবার কোথাও কোথাও বেড়েছে। সারারাত ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বসতবাড়ির উঠোনে ও গ্রামীন সড়কে পানি উঠে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম কিংবা হাট বাজারে যাতায়াতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন নিচু এলাকার লোকজন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় সরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর পয়েন্টে ৭ দশমিক ৭৪ মিটারে ছিল। বৃহস্পতিবার একই সময় সেখানে পানি ছিল ৭ দশমিক ৮০ মিটারে। গতকাল শুক্রবার সুরমার পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়াও জেলার ছাতক উপজেলা শহরের কাছে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বেড়েছে ৮ সেন্টিমিটার। তাহিরপুর উপজেলার পাটলাই নদীর সোলেমানপুর পয়েন্টেও পানি বেড়েছে। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ শহরের উত্তর আরপিননগর এলাকার সুরমা নদীর তীরবর্তী সড়ক ও সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী মঙ্গলকাটা বাজার প্লাবিত হয়েছিল বৃহস্পতিবার। গতকাল শুক্রবার এসব এলাকা থেকে পানি কিছুটা নেমেছে। সদর উপজেলার সুরমার তীরের ইব্রাহিমপুর গ্রামের বাসিন্দা বৃষ্টি আক্তার বলেন, সারা রাতই বৃষ্টি হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ির উঠোনে পানি উঠেছে। দুপুরের দিকে রোদ উঠার সঙ্গে সঙ্গে পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মাসের শেষে ও চলতি মাসের শুরুর দিকে সুনামগঞ্জে ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওড়গুলো এখন পানিতে টইটম্বুর। এখন বৃষ্টি ও উজান থেকে নামা ঢলে জেলার সুরমা, চলতি, জাদুকাটা, রক্তি, পাটলাই, বৌলাই, কুশিয়ারা, চেলা, নলজুর, খাসিয়ামারা, কালনীসহ সব নদীর পানি বাড়ছে। বৃহস্পতিবার রাতে পাহাড়ি ঢল কম নামায় পানি কিছুটা কমছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার জানিয়েছেন, মূলত ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাত হলেই সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল নামে। ফলে জেলার নদী ও হাওড়গুলোতে পানি বৃদ্ধি পায়। তিনি আরো জানান, গত বুধবার চেরাপুঞ্জিতে ২৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে করে ভারতের উজানের ঢল নামছে সুনামগঞ্জে। এ কারণে সুনামগঞ্জে বৃষ্টি কম হলেও নদী ও হাওড়ের পানি বাড়ছে। তবে এতে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, আপাতত সুনামগঞ্জে বন্যার কোনো পূর্বাভাস নেই। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলায় এখনো বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তারপরও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা মোকাবিলা করতে ৬৫০ টন জিআর চাল, নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ১ হাজার ৬০০ পেকেট শুকনো খাবার মজুত রাখা আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App