×

সারাদেশ

হেলালের মৃত্যু: সংঘর্ষে নাকি পরিকল্পিত খুন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৩, ১১:১৪ পিএম

হেলালের মৃত্যু: সংঘর্ষে নাকি পরিকল্পিত খুন?

শাল্লা ইউপির সাতপাড়া বাজারে এই ঘর তৈরিকে কেন্দ্র করেই সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়। ছবি: ভোরের কাগজ

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় গত ২৭ জুন সাতপাড়া বাজারে ঘর তৈরিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ৪ নং শাল্লা ইউপির সাবেক সদস্য কার্তিকপুর গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান (৪৮) টেঁটাবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

সংঘর্ষের প্রায় তিন ঘণ্টা পর একই গ্রামের ইউসুফ মিয়া গ্রুপের কুদ্দস মিয়ার ছেলে হেলাল মিয়া (২৫) নামের অপর এক যুবকের মৃত্যুর খবরও এসেছে।

হেলাল মিয়ার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মধ্যে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। কেউ বলছেন, পরিকল্পিতভাবে তাকে খুন করা হয়েছে। আবার অনেকই বলছেন, হেলাল মিয়ার মৃত্যু রহস্যজনক। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, হেলাল মিয়া সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থলেই ছিল না। হেলাল মিয়া সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে তার বোনের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলায় অবস্থান করছিল। সংঘর্ষের খবর শুনে একটার দিকে সাতপাড়া বাজারে আসে সে। উভয়পক্ষের সংঘর্ষ চলে দুই ঘণ্টাব্যাপী। গত মঙ্গলবার (২৭ জুন) উপজেলার সাতপাড়া বাজারে সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বেলা ১২টায় সংঘর্ষ শেষ হয়। ভয়াবহ এই সংঘর্ষ চলাকালীন বাজারের ব্যবসায়ীদের মাঝে তৈরি হয় আতঙ্ক।

প্রত্যক্ষদর্শীরা এই প্রতিনিধিকে তথ্য দিয়েছেন, দা, বল্লম, টেঁটা, রড ও লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল ইউসুফ মিয়ার লোকজন। ঘটনার পর থেকেই বৈরী আবহাওয়া ও শাল্লা সদর থেকে সাতপাড়া বাজার ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে থাকার কারণে গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়। সম্প্রতি সাতপাড়া বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যে ঘর নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত সেই বাঁশের খুঁটি ও টিনসেট দ্বারা নির্মিত টং আকৃতির ঘরটি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সাতপাড়া বাজারের উত্তরাংশে। সাংবাদিকদের দেখে জড় হয় এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ শতাধিক সাধারণ মানুষ।

কার্তিকপুর গ্রামের সফি মিয়া বলেন ১০টার দিকে মারামারি শুরু হইছে, শেষ হইছে প্রায় ১১টার দিকে। হেলাল মিয়া ছিল আজমিরিগঞ্জ বোনের বাড়িতে। হেলাল বাজারে আসে একটার দিকে। বিকেল তিনটার দিকে শুনি হেলাল মারা গেছে। হেলালের মৃত্যু রহস্যময়। ইউসুফ মিয়ার গ্রুপ আগেই দেশিয় অস্ত্র নিয়া বাজারে আইছে। মারামারিটা শুরুও করছে তারা।

ওই বাজারের দর্জি ব্যবসায়ী সুনীল দাস বলেন হেলালকে আমি দেখছি পৌনে দুইটার সময় আদিত্যপুর গ্রামের দিকে যায়। পরে শুনি, হেলালের মৃত্যু হয়েছে।

এ ব্যাপারে শাল্লা ইউপির ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য আমির হামজা বলেন ঘর তৈরিকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এতে সাবেক মেম্বার হাবিবুর রহমান মারা যায়। মারামারির তিন ঘণ্টা পর হেলালের মৃত্যুর খবর আসে, যা একেবারেই রহস্যজনক। কারণ সংঘর্ষের সময় হেলাল এখানে ছিল না।

ব্যবসায়ী রাখাল সরকার বলেন আমি বাঁশের ব্যবসা করি। আমার ব্যবসার ১০০ ফুট দূরে যে ঘরটি নিয়া মারামারি হইছে। অনেক সময় মারামারি হইছে। পরে প্রশাসনের লোকজন মারামারি থামায়। আনুমানিক ১২টার দিকে মারামারি শেষ হয়। এর মধ্যে শুনি, হাবিব মেম্বার মারা গেছে। পরে ইউসুফ মিয়ার গ্রুপ আদিত্যপুর গ্রামের দিকে যায় আর মুজিবুর রহমানের গ্রুপ বাজারের দিকে যায়। মারামারির এক ঘণ্টা পরে হেলাল আমার সামনে দিয়া যাইতাছে (যাচ্ছে) আর কইতাছে (বলছে), আমি আজমিরিগঞ্জ ছিলাম। আমি থাকলে আরও দুই-চারটারে ফালাইলামনে মাইরা (মেরে ফেলবো)। এর প্রায় তিন ঘণ্টা পরে শুনি হেলাল মারা গেছে। এই মার্ডারটা (খুন) আমার কাছে রহস্যজনক মনে হয়।

এবিষয়ে শাল্লা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস ছাত্তার মিয়া বলেন সাতপাড়া বাজারে কোনো খাস জমি নাই। মুজিবুর রহমানের ছয়টি দলিল আমরা দেখেছি। এটা রেকর্ডের জায়গা। খোঁজ নিয়ে দেখছি আমার এলাকারই একটি ছেলে ভাড়ায় প্রীডবোট চালায় তারে খবর দিয়া নিছে হেলাল মারা গেছে কইয়া। সাথে কার্তিকপুর থেকে দুজন মহিলারে নিয়া যেতে বলেছে নিজামের লোকজন।

নিজাম উদ্দিন একজন পেশাদার খুনি। হেলালের মৃত্যুটা মিথ্যা। কামারগাঁওয়ের জয়নালরে হত্যা করছে সে। তখনও আমি এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম। হেলালরে হাওরে নিয়া তারাই মারছে। পরিকল্পিতভাবে হেলালকে খুন হয়েছে। সংঘর্ষে পুলিশকেও আঘাত করেছে নিক্সন। যা এসআই আলিম উদ্দিন নিজেই তাকে বলেছেন বলে জানান তিনি।

সাতপাড়া বাজার ব্যবসায়ী কমিটির কোষাধ্যক্ষ রণ সরকার বলেন ইউসুফ মিয়া টাকা তুলে বাজার থেকে। কেনো টাকা তুলেন জানতে চাইলে সে বলে উপর থেকে ডাক আনছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা দিরাই এমপির কাছে গেলাম। এমপি সাথে সাথে ইউএনওকে ফোন দেন। ইউএনও বলেছেন এই বাজারটি ডাক হয়নি। কিন্তু টাকা উত্তোলন বন্ধ হয়নি। পরে তারা ধীরেধীরে বাজারের অন্যের রেকর্ডের জায়গায় ঘর তৈরি করতে থাকে। অনুপ দাসের রেকর্ডিয় জায়গায়ও দুই বছর আগে একটি ঘর তৈরি করেছে। অনুপ বাঁধা দিলেও শুনেনি তারা। হিন্দুরাও ইউসুফ গ্রুপের দ্বারা নির্যাতিত। গত ২৭ জুন মুজিবুর রহমানের জায়গায় ঘর তৈরি করাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে হাবিবুর রহমান টেঁটাবিদ্ধ হয়ে বাজারেই লুটিয়ে পড়েন। পরে আজমিরিগঞ্জ নেয়ার পথে মারা যান তিনি। বিকেলে হেলাল মিয়ার মৃত্যু সংবাদ শোনা যায়। এটি সন্দেহজনক। কেননা হেলাল সংঘর্ষের সময় এখানে ছিলই না বলে জানান তিনি।

অপরদিকে, ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুঠোফোনে বলেন আমি বাঁশ নিতে সাতপাড়া বাজারে আসছিলাম। তখনও মারামারি শুরু হয় নাই। কিছুক্ষণ পুরেই মারামারি শুরু হয়ে যায়। আমি ভয়ে চলে আসি আদিত্যপুরে। আনুমানিক দুপুর দুইটা-আড়াইটার দিকে আমি বলরামপুর গ্রামের হাইস্কুলে আমার নৌকার কাছে যাই। সেখানে ইউসুফ মিয়া, নিজাম উদ্দিন, আলমগীর মিয়াসহ আরেকটি ছেলে ছিল নাম জানি না তারা আমার নৌকা জোর করেই নিয়ে যায় মুরাদপুর গ্রামে। সেখানে গিয়ে ইউসুফ মিয়া, নিজাম উদ্দিনরা নেমে যায়। সেখানেই আরেকটি ডিঙি নৌকায় আমি হেলাল মিয়াকে সুস্থ অবস্থায় বসে থাকতে দেখেছি। ডিঙি নৌকার ইঞ্জিন ২৪ ঘোড়া। খুবই দ্রুতগতিতে চলে ডিঙি নৌকাটি। পরে সেখান থেকে কামাল, আলাল, নিক্সনসহ ১৪ জন আমার নৌকায় উঠে আমাকে দিরাই উপজেলার মিলন বাজারে দিয়ে আসতে। ওই ডিঙি করে হাওরে দিয়ে হেলালসহ আরো সাতজন কোথায় গেছে আমি জানি না।

এ বিষয়ে ইউসুফ গ্রুপের পক্ষে মামলার বাদী মিনারা বেগম মুঠোফোনে বলেন হেলাল মারামারিতে ছিল। হেলাল মারামারি ছিল না আপনারে কেডায় কইছে? এলাকাবাসীর কথা বললে তিনি বলেন তারা সব মুজিবুরের লোক। হেলালকে কেনো শ্রীহাইল দাফন করা হলো এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক ছিল না। মুসলমানদের তো জানাজা-টানাজা পড়াতে হয়, গোসল পড়াতে হয়। আমরা মহিলা মানুষ কেমনে করি- তাই ফোন দিছি চৌধুরী সাহেবের লোক আফজালকে। আফজাল বলছেন, নিয়া আহ আমরার এখানে মোল্লা মুন্সি আছে আমরা দাফন-কাফন পড়াইয়া দি মুনে বলে জানান তিনি।

শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম বলেন এই বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে যাচ্ছি। যাতে নিরপরাধ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রকৃত অপরাধীদের অবশ্যই আমরা খোঁজে বের করবেন বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, গত ২৭ জুন ইউসুফ মিয়ার গ্রুপের একটি ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে মুজিবুর রহমান গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে হাবিবুর রহমান ও হেলাল মিয়া মারা যায়। তবে হেলাল মিয়ার মৃত্যুকে ঘিরে উপজেলাজুড়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যেই উভয়পক্ষই মামলা দায়ের করেন। অন্যদিকে পুলিশ বাদী হয়ে অপর একটি অ্যাসল্ট মামলা দায়ের করেন। তিনটি পৃথক মামলায় আসামী করা হয়েছে শতাধিক। পুলিশ অ্যাসল্ট মামলায় মুজিবুর রহমান ও মিনা বেগমের দায়ের করা মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগার পাঠায় পুলিশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App