×

সারাদেশ

উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির তীব্র সংকট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩, ১২:৩৭ এএম

উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির তীব্র সংকট

সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছে সাতক্ষীরাবাসী। পৌরসভা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি উপজেলায় একই চিত্র। লবণাক্ততা, আর্সেনিক ও আয়রনের প্রভাবে সুপেয় পানির চরম সংকটে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে সাতক্ষীরা জেলার লাখ লাখ মানুষের। দাবদাহ এই সংকট বাড়িয়েছে বহুগুণ। এমন পরিস্থিতিতে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি বাড়ছে দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব।

সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সুপেয় পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সংকট ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। প্রায় সব এলাকায় পানি না পেয়ে মানুষ এখন গভীর নলকূপ ব্যবহার করে আর্সেনিক ও ক্ষতিকর নানা উপাদান মিশ্রিত সোনালি রঙের পানি পান করছে। অস্বাস্থ্যকর পানি ব্যবহার ক্রমশ ছড়াচ্ছে রোগবালাই। পানি ছাড়া যেখানে জীবন অচল, সেখানে রোগবালাই থেকে বাঁচার জন্য নি¤œআয়ের মানুষকেও বাধ্য হয়ে পানি কিনে পান করতে হচ্ছে। এতে দিন দিন বাড়ছে পরিবারের ওপর অর্থনৈতিক চাপ।

সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সাতক্ষীরা সদরসহ উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে সুপেয় পানির সংকট। ফলে জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনে পানি সংকটের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্য হ্রাস, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মাটি-পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ মানুষ সৃষ্ট কারণে এ সংকট দেখা দিয়েছে। যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই সংকট উত্তরণে বাধা হিসেবে রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, দুর্বল নীতি বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং, অপ্রতুল বরাদ্দ, জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি এবং জনঅংশগ্রহণের অভাব। অবিলম্বে এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে জনগণের জন্য সুপেয় পানি পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।

আরো দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ দুর্বল হওয়ার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগে লবণপানি ঢুকে চাষযোগ্য জমি ও সুপেয় পানির আধারগুলো নষ্ট হচ্ছে। চারদিকে শুধু লবণপানি, কিন্তু খাবারের পানি নেই। খাবার পানি সংগ্রহ করার জন্য একজন নারীকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। তাও আবার অপরিশোধিত পুকুরের পানি। গভীর নলকূপগুলো পড়ে আছে নষ্ট হয়ে। যেগুলো সচল সেগুলোর পানিও পানের উপযুক্ত নয়। সুপেয় বা ব্যবহারের উপযুক্ত পানি মানুষের অধিকার। কিন্তু সুপেয় পানির অভাবে মানুষ পুকুর ও গভীর নলকূপের অপরিশোধিত দূষিত পানি পান করে নানাবিধ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে নারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। পানি সংগ্রহ করতে তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়।

সাতক্ষীরার বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করলেও পানির অধিকার নিশ্চিত হয়নি। উপকূলে এই সংকট সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। সাতক্ষীরার যুব, নারী, পুরুষসহ পানি সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, সুপেয় পানি সর্বজনীন, ন্যায্য ও টেকসই প্রবেশ নিশ্চিত করতে সরকারি বরাদ্দ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করা, এলাকাভিত্তিক বড় বড় পুকুর-খাল-জলাশয় খনন করে তাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা এবং খাসজমিতে মিঠা পানির আধার তৈরি করার দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে।

সাতক্ষীরা জেলা জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের সভাপতি ও শিক্ষাবিদ আব্দুল হামিদ বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে সাগরের তলদেশ ও নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সাগরের লবণাক্ত পানি উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর পানির অধিকার ক্ষুণ্ন করছে এবং মানুষের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সুপেয় পানির সংকটের কারণে উপকূলের মানুষ নানা সমস্যায় পড়ছেন। কৃষি উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, খাবার পানি, রান্নাবান্নাসহ দৈনন্দিন কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে অনেকেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। নারীদের ক্ষেত্রে খিঁচুনি, জরায়ুর সমস্যাসহ গর্ভবতী নারীদের বিবিধ ঝুঁকি বাড়ছে। দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা ব্যয় হচ্ছে, আবার নিপীড়নের শিকারও হচ্ছেন অনেকেই।

তিনি আরো বলেন, দেশের ৯৮-৯৯ শতাংশ মানুষ সাধারণভাবে পানির সুবিধা পেলেও গুণগত মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি এখনো সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়নি। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে- এটা একটা বড় সমস্যা। পানি শোধনাগার যা আছে, তাও যথেষ্ট নয়। তবে আশার কথা হলো, সরকার এসডিজি লক্ষ্য পূরণের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা বাড়াতে প্রতি অর্থবছরে বাজেট অনেক বাড়ানো হচ্ছে। এসব খবর আমাদের আশাবাদী করে তোলে। বাস্তবিক অর্থেই পানিসংকট এখন সবার জন্য লাল সংকেত। এই কথাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে সরকারকে।

সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও ফোরামের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। এরই মধ্যে সাতক্ষীরায় বিশুদ্ধ খাবার পানির দুষ্প্রাপ্যতা তৈরি হয়েছে। পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় খাবার পানির সংকটে ভুগছে এখানের বাসিন্দারা। গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র লোকটাকেও টাকা দিয়ে লিটার দরে পানি কিনে খেতে হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নেমে যাচ্ছে। দেশের প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষ নিরাপদ ও সুপেয় পানির আওতার বাইরে।

এদিকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার দেশের অনেক এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি থাকা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হচ্ছে। সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে উপকূলীয় অঞ্চলসহ জেলার সর্বত্রই।

তিনি আরো বলেন, প্রাকৃতিক জলাধারের ওপর অত্যাচার তথা দখল, ভরাট ও গতিপথ পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে পানিচক্রের ভারসাম্য ও ন্যায্যতা নষ্ট হয়। পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। তাই নিরাপদ পানির উৎস হিসেবে জলাধার রক্ষার পাশাপাশি পরিত্যক্ত পুকুর খনন বা পুনঃখনন করতে হবে। পুকুরভিত্তিক পানি শোধনাগার নির্মাণ করতে হবে। প্রতি বছর পানিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ও দূষিত পানি পানের কারণে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পাশাপাশি পানিতে আর্সেনিক একটি বড় সমস্যা। আবার শহরে পাইপলাইনের মাধ্যমে যে পানি সরবরাহ করা হয় সেখানে ৮০ শতাংশই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া যুক্ত। পুকুরের পানিতেও এ ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিছু অঞ্চলের টিউবওয়েলের পানিতে ক্ষতিকর অণুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে। মাটির নিচে ক্রমেই কমছে সুপেয় পানির আবাস। একমাত্র ভরসা এখন পুকুর। সেখান থেকে প্রতিদিন এমন লাইন ধরে খাবার পানি সংগ্রহ করেন এলাকাবাসী। এসব সংকট সমাধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরুর আহ্বান সংশ্লিষ্টদের। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ন কবির বলেন, উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে জলোচ্ছ¡াস ও বেড়িবাঁধ ওভারফ্লো হয়ে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সময়মতো টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যায় না। এরকম একটা সংকট আমাদের এখানে রয়েছে। এটা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার যথেষ্ট আন্তরিক এবং ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে।

তিনি বলেন, আমাদের রেইন ওয়াটার হারভেস্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পট এবং তিন চার হাজার লিটার পানির পাত্র, বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর মাধ্যমে আমাদের উপকূলীয় তিনটি উপজেলা শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য ৫০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প সরকার গ্রহণ করেছে। আমি আশাকরি এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করতে পারব।

বড় বড় পুকুর-খাল-জলাশয় খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা এবং খাসজমিতে মিঠা পানির আধার তৈরি সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে জেলা পরিষদ কিছু কাজ করেছে। আমরাও বড় বড় পুকুর-খাল-জলাশয় ডোবা পুনঃখনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে এ সংকট কেটে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App