×

সারাদেশ

সিলেটে সুষ্ঠু ভোটের প্রত্যাশা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৩, ০১:০৩ এএম

সিলেটে সুষ্ঠু ভোটের প্রত্যাশা

ঠিক এক বছর আগে ২০২২ সালের ২০ জুন, শতাব্দীর প্রলয়ংকারী বন্যায় সিলেট মহানগরী পুরোটাই ছিল পানির নিচে। এই বছরও পানি বাড়ছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা। আশঙ্কা করা হচ্ছে বড় বন্যার। এরই মধ্যে আজ বুধবার নগরপিতা নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে সুরমাবাসী। কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে ইভিএমসহ নির্বাচনসামগ্রী। জাতীয় নির্বাচনের আগে শেষ এসিড টেস্টে উত্তীর্ণ হতে প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মাঠে রয়েছেন ২৬০০ পুলিশ। তবে পর্যাপ্ত ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনা, বিএনপির ভোটব্যাংক, সিলেটি ইগো, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নতুন ওয়ার্ড ভোট ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই আজ নির্ধারিত হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী বনাম বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ভাগ্য। নৌকার বিজয় নাকি লাঙ্গলেই মঙ্গল- এর ফলাফল পেতে আর কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষামাত্র।

জানা গেছে, নির্বাচন বর্জন করে দল থেকে বহিষ্কারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পরও বিএনপির ৪২ জন ও জামায়াতের ২০ জন নেতাকর্মী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। কাউন্সিলর পদে ভোট দিতে বিএনপি-জামায়াতের ভোটাররা যদি কেন্দ্রে যান, সে ক্ষেত্রে মেয়র পদে তারা কাকে ভোট দেবেন- এটি এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভোটের হিসাবনিকাশে সরকারবিরোধী ‘ভোটব্যাংকের’ দিকে নজর রাখছেন মেয়র প্রার্থীরা। নৌকার প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিপরীতে লাঙ্গল প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধী ভোট টানতে পারেন, সাধারণভাবে এমন ধারণা করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। তবে বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকজন নেতা বলছেন, তাদের দল নির্বাচন বর্জন করায় কর্মী-সমর্থকরা ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন না। মূলত কাউন্সিলর প্রার্থীদের আত্মীয়স্বজন ভোট দিতে যাবেন। এই প্রার্থীদের অনেকে আবার স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা প্রভাবিত। এ বিবেচনায় তাদের ভোটাররা জাতীয় পার্টির চেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই বেশি গুরুত্ব দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

ভোটারদের কেন্দ্রে আনাই চ্যালেঞ্জ : দলীয় ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে বিএনপি তৎপর। আর আওয়ামী লীগ চিন্তা করছে, বিএনপি-জামায়াত সমর্থক বা ভোটার বেশি আছে, এমন ওয়ার্ডে কীভাবে ভোটার উপস্থিতি কমানো যায়। অন্যদিকে সরকারবিরোধী ভোট আছে, এমন ওয়ার্ডে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াতে করণীয় ঠিক করছে জাতীয় পার্টি। তবে জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীও তাদের কর্মী-সমর্থকদের কিছু ভোট পাবেন। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায় ভোটের ভাগ্য আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষেই থাকবে বলে মনে করছেন অনেক ভোটার। ভোটারদের ধারণা, এটি একটি নিরলস নির্বাচন হতে চলেছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোনো রাজনৈতিক কিংবা বড় পরিসরে সামাজিক সম্পৃক্ততা না থাকায় তাদের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর উপযুক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে বিবেচনা করছেন না ভোটাররা। শক্ত প্রতিদ্ব›িদ্বতা না থাকায় সিলেট সিটি নির্বাচনে কম ভোটারের উপস্থিতিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে ধারণা সচেতন নাগরিকদের। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের উদাসীনতার কারণে ২০২০ সাল থেকে সাম্প্রতিক নির্বাচনে খুব কম ভোটারের উপস্থিতি দেখা গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিএনপির প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতায় থাকার পরও ২০২০ সালের ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ২৯ শতাংশ এবং উত্তর সিটি নির্বাচনে মাত্র ২৫ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০২১ সালে সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল এবং এ নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, বগুড়া-৪ ও ৬ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩ আসনের উপনির্বাচনেও খুবই কম ভোটার ছিল। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ। তবে গত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে খুলনায় ৫৭ শতাংশ, বরিশালে ৫১ শতাংশ এবং গাজীপুরে ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে।

ভোটারদের এই উদাসীনতাকে কাটিয়ে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, নির্বাচনে পর্যাপ্ত ভোটার উপস্থিতি থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। নির্বাচনী প্রচারণার জন্য আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করেছি। কমিটিগুলো নির্বাচনের দিন ভোটারদের ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে উদ্বুদ্ধ করতেও কাজ করবে।

জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্বাস উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, ভোটাররা ভোট দিতে আগ্রহী। আমরা সবার দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। মানুষের ব্যাপক সাড়া পেয়েছি।

ফ্যাক্টর নতুন ওয়ার্ডগুলোর সোয়া লাখ ভোটার : ২৬ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার সিলেট সিটি করপোরেশনের আয়তন বাড়িয়ে ২০২১ সালে ১৭৯ বর্গকিলোমিটার করা হয়। এ সময় নগরের ২৭টি ওয়ার্ড বেড়ে ৪২টিতে পরিণত হয়। নগর বর্ধিতকরণের প্রায় দুই বছর হতে চললেও এখন পর্যন্ত নতুন ১৫টি ওয়ার্ডে লাগেনি কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত এসব এলাকার ভোটাররা। ফলে নামে নগর হলেও সিলেট সিটির নতুন ১৫টি ওয়ার্ড এখনো যেন একেকটি গ্রাম। অপ্রশস্ত ও ভাঙাচোরা, কোথাও বা কাঁচা সড়ক; অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা- যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ; সুপেয় পানীয় জলের অভাব, জলাবদ্ধতা, মশার উপদ্রব, সড়কবাতি না থাকা নিত্য সমস্যা। নতুন ১৫টি ওয়ার্ডে ৪টি আঞ্চলিক অফিস স্থাপন করলেও এখন পর্যন্ত এসব এলাকায় নেই সিটি করপোরেশনের কোনো কার্যক্রম। তবে নগর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ধিত ওয়ার্ডের উন্নয়নে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি পাস হলে এসব ওয়ার্ডের চেহারা বদলে যাবে।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমি নির্বাচিত হলে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে সুষম উন্নয়ন করব। ওয়ার্ডভিত্তিক আলাদা উন্নয়ন পরিকল্পনা করব।

জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, আমি মেয়র নির্বাচিত হলে নতুন ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব দেব। কারণ এই ওয়ার্ডগুলো একেবারে অবহেলিত আছে।

মাঠে ২৬০০ পুলিশ : সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন করতে নগরীতে প্রায় ২৬০০ পুলিশ সদস্য মাঠে আছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরিফ। তিনি বলেন, মাঠে রয়েছেন ১৪ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ৪২টি ওয়ার্ডে ৪২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাচনে কোনো বিশৃঙ্খলা হলে তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন। নির্বাচনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে একজন পরিদর্শক, একজন উপপরিদর্শক ও পাঁচজন পুলিশ সদস্য এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডে একজন পরিদর্শক, একজন উপপরিদর্শক ও চারজন পুলিশ সদস্য এবং সাতজন নারী ও সাতজন পুরুষসহ মোট ১৪ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।

তিনি জানান, নির্বাচন উপলক্ষে প্রতি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে পুলিশের ৪২টি মোবাইল টিম, প্রতি তিনটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে ১৪টি স্ট্রাইকিং টিম এবং প্রতি থানায় একটি করে ছয়টি রিজার্ভ স্ট্রাইকিং টিম থাকবে। পাশাপাশি দুই ওয়ার্ডে একটি করে র‌্যাবের মোট ২২টি ও পাঁচ ওয়ার্ডে এক প্লাটুন করে মোট ১০ প্লাটুন বিজিবির টহল থাকবে। এ সময় পুলিশ কমিশনার নির্বিঘেœ ভোটদানের জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান।

ভোট শান্তিপূর্ণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন : সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে নির্বাচন কমিশন থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সল কাদের বলেন, বৃষ্টির কারণে ভোটে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। বৃষ্টির মধ্যে ভোটার কেমন আসবেন এখনই বলা যাচ্ছে না। আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলে ভোটাররা আসবেন। ভোটের জন্য সব কেন্দ্র প্রস্তুত থাকবে। মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসবেন। চার-পাঁচটা কেন্দ্রের মাঠে পানি উঠেছে। ওসব কেন্দ্রে পানি নিষ্কাশনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে। সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ১৯০টি কেন্দ্রে ১ হাজার ৭৪২টি সিসি ক্যামেরা ইতোমধ্যে লাগানো হয়েছে। প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা থাকবে। তবে গোপন কক্ষ সিসি ক্যামেরার আওতার বাইরে থাকবে।

প্রসঙ্গত, সিলেট সিটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৬০ জন, আর ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮৭ জন হলেন নারী ভোটার। এখানে হিজড়া সম্প্রদায়ের রয়েছেন ছয়জন। জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুর, খুলনা ও বরিশালের পর শেষ ধাপে আজ বুধবার ভোট হচ্ছে সিলেট ও রাজশাহী সিটিতে। এই দুই সিটি নির্বাচনেও ভোট হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএমে। কেন্দ্রে ভোট পরিস্থিতি এবারও সিসি ক্যামেরায় দেখবে কমিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App