×

সারাদেশ

‘পোয়া-মাইয়্যা লই কী কইয্যুম, গুমায়ুম কডে’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৩, ১০:২৮ এএম

‘পোয়া-মাইয়্যা লই কী কইয্যুম, গুমায়ুম কডে’

ছবি: ভোরের কাগজ

‘পোয়া-মাইয়্যা লই কী কইয্যুম, গুমায়ুম কডে’

ছবি: সংগৃহীত

‘পোয়া-মাইয়্যা লই কি কইয্যুম? গুমায়ুম কডে? গা’ত কী দিয়্যুম? সব লই গেয়্যয়েগই দজ্জ্যা। ডিঙি নৌকাত গরি মাছ ধরত্যাম, তুফানে নৌকাও লই গেয়্যয়েগই। আঁরা এহন কী গরজ্জ্যুম?’ (ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন কী করব? ঘুমাব কোথায়? গায়ে কী পড়ব? সবকিছু সাগরে নিয়ে গেছে। ডিঙি নৌকায় করে মাছ ধরতাম। সেই নৌকাও ঘূর্ণিঝড় নিয়ে গেছে। আমরা এখন কী করব?)।

অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোকায় নিজের সর্বস্ব হারিয়ে বিধ্বস্ত ঘরের সামনে বসে কথাগুলো বলছিলেন মো. ইদ্রিস। আর পেছনে শিশু কন্যাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ঘর ঠিক করতে অনেক টাকা দরকার। এত টাকা আমরা কোথায় পাব? আমাদের সামান্য কিছু হলেও সহযোগিতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

শুধু ইদ্রিস ও ইয়াসমিন দম্পতি নয়, মোকায় বিধ্বস্ত হওয়া শাহ পরীর দ্বীপের জেলেপাড়া, ক্যাম্পপাড়া, বাজারপাড়া ও মিস্ত্রিপাড়া এবং টেকনাফ সদরের জাঁহালিয়াপাড়া, মাঠপাড়া, মিঠাপানিরছড়া, মহেশ খালিয়াপাড়ার বাসিন্দারা ত্রাণ ও আর্থিক সহযোগিতার আকুতি জানিয়েছেন।

সোমবার টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপসহ ওই এলাকাগুলোতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। এদিকে, মোকা যে শক্তিতে আঘাত হানবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল ততোটা শক্তিতে আঘাত না হানলেও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেন্টমার্টিন ও শাহ পরীর দ্বীপ। এই দুটি দ্বীপসহ টেকনাফ উপজেলাজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি। আড়াই হাজারের মতো ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। শুধু ঘরবাড়িই নয়, ঝড়ের তাণ্ডবে টেকনাফে নষ্ট হয়েছে দুই শতাধিক পানের বরজ। বড় বড় গাছ সড়কে উপড়ে পড়ায় সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ ছিল অনেক সড়ক। ঝড়ে আক্রান্ত শাহ পরীর দ্বীপে দেখা দিয়েছে তীব্র খাবার পানির সংকটও।

ঝড়ে উড়ে গেছে অনেক টিনের বেড়া। নষ্ট হয়ে গেছে কলাগাছের বাগান। ২০-৩০ লাখ টাকার আম পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ঝড়ের পর টেকনাফে আর বিদ্যুৎ আসেনি। কবে আসবে সেটিও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এতে বেকায়দায় পড়েছেন উপজেলার বাসিন্দারা।

এদিকে কক্সবাজার থেকে টেকনাফে আসার সময় ইনানী বিচের পর মিঠাপানিরছড়া এলাকা থেকে ঝড়ের তাণ্ডব চোখে পড়া শুরু হয়। এরপর যতই টেকনাফের দিকে আগানো হয়েছে ততই চোখে পড়েছে গাছ উপড়ে পড়া, পানের বরজ ধ্বংস হওয়া, রাস্তার পাশে থাকা বিভিন্ন বাড়ির টিনের বেড়া উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য চোখে পড়ে শাহ পরীর দ্বীপের জেলেপাড়াতে গিয়ে। বিধ্বস্ত ঘরগুলোর কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি মোকা। বিদ্যুতের খুঁটির উপর একটি ঘরের চাল ঝোলার দৃশ্য দেখেই সহজে অনুমান করা যায় কতটা বিধ্বংসী ছিল মোকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধসংলগ্ন ঘরগুলো। ঝড়ের তাণ্ডবে টিন, বাঁশ, কাঠ ও পলিথিন দিয়ে তৈরি ঘরগুলো বিধ্বস্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে ঘরগুলোতে থাকা আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল, তোশক-বালিশসহ সবকিছু। ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে নিজের পরিচয়পত্র আর পড়নের কাপড় ছাড়া কিছুই বাঁচাতে পারেননি। শুধু ঘর নয়, ঝড়ে উড়ে গেছে টয়লেট ও রান্নাঘরও। সরকারি কোনো ত্রাণ সেখানে না পৌঁছানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সবাই। সেই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পলিথিন টানিয়ে ঝুপড়ি বানাতে দেখা গেছে। অনেককে ভাত খেতে ও ঝুপড়ি তুলতে টাকা ধার করার জন্য ছোটাছুটি করছিলেন।

[caption id="attachment_430905" align="aligncenter" width="700"] ছবি: ভোরের কাগজ[/caption]

অপরদিকে টেকনাফ উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, মোকার কবলে পড়েছে উপজেলার ১৬০ হেক্টর শাকসবজির খেত। ১০ হেক্টর জমির শাকসবজি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫০ হেক্টর জমির সবজি। ৪০ হেক্টর জমির পানের বরজ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ১৪০ হেক্টও জমির পানের বরজের। আর আম ঝড়ে পড়েছে ২২৬ হেক্টর জমিতে থাকা হাজারো গাছে। এতে আনুমানিক ২০-৩০ লাখ টাকার আম ঝড়ে পড়ে গেছে।

কিছুই অবশিষ্ট নেই মুরছানাদের : ৫ বছর আগে স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়া মুরছানা বেগমের ৩ ছেলেমেয়ে। জেলেপাড়ায় একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে সংসার চালান। মোকায় উড়ে গেছে তার একমাত্র অবলম্বন ঘর ও গোয়ালঘর। বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করতেন বিক্রির জন্য। করেছিলেন ছোট পেঁপে বাগানও। কিন্তু মোকার তাণ্ডবে সব শেষ। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে মুরছানা ভোরের কাগজকে বলেন, সাইক্লোন সেন্টারে গিয়ে আমরা শুধু জীবনডা বাঁচাইছি। এখন চলব কীভাবে। বিধ্বস্ত ঘরের ভাঙা জিনিসপত্র দিয়ে নিজেদের শোয়ার ব্যবস্থা করেছি। গরু-ছাগল রাখব কোথায়? কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন? জানতে চাইলে মুরছানা বলেন, কিছুই পাইনি। টাকা ধার চেয়েও পাচ্ছি না কারো কাছে। আমার মোবাইল নম্বরটা নিয়ে যান। কেউ সহযোগিতা করতে এলে আমাদের জানায়েন।

মুরছানার ঘরের পাশেই বেড়িবাঁধের সঙ্গে থাকা দিলদার আলমের ঘরের চালার টিন আটকে থাকতে দেখা যায় বিদ্যুতের খুঁটির উপরে। ঘরের বেড়া এবং আসবাবপত্র এদিক সেদিক ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ৬ বছরের মেয়েকে বিধ্বস্ত ঘরের মালামাল পাহারা দিতে রেখে পলিথিন কিনতে যান দিলদার। তার দুলাভাই নূর আলম ভোরের কাগজকে বলেন, আমার নিজের ঘরের শুধু চালা উড়ে গেছে। আর দিলদারের ঘরের চিহ্ন পাওয়াও কষ্টকর। ক্যাম্পপাড়ার বাসিন্দা শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. রফিক। টিনের ঘরের সঙ্গে ঝুপড়ি উঠিয়ে মুদি দোকান দিয়েছেন। পাশেই টিনের ঘর তুলে থাকেন তার ছেলে ইয়াহিয়া। মুদি দোকান ও রফিকের ঘর উড়িয়ে নিয়ে গেছে মোকা। রফিকের ঘরেরও বেড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মোকার কবলে পড়া শাহ পরীর দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন, এই এলাকায় তীব্র খাবার পানির সংকট আগে থেকেই। মোকায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঘুরে দাঁড়াতে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করার আকুতি জানান তারা। সাবরাং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আবদুস সালাম ভোরের কাগজকে বলেন, শাহ পরীর দ্বীপে ৮০০ এর মতো ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবার তালিকা করা হচ্ছে। এটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের মাধ্যমে উপজেলায় জমা দেয়া হবে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ ছোট বড় ৩ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেন্টমার্টিনে- ১ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখানে ২ হাজার প্যাক ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের মেরামত শুরু : ভোরের কাগজের উখিয়া প্রতিনিধি জসিম আজাদ জানিয়েছেন, মোকার ছোবলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষতিগ্রস্ত আড়াই হাজার ঘর ইতোমধ্যে মেরামতে কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যে ঘরগুলো ক্ষতি হয়েছে সেগুলো মেরামতে আমাদের টিম কাজ করছে। আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম, বাতাসের গতিবেগ যাই হোক না কেন, এগুলো যেহেতু অস্থায়ী ঘর, সুতরাং এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়া ছিল। এখন সেগুলো আবারো মেরামত দেয়া হবে। ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আমির জাফর জানান, ঘূর্ণিঝড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপনের কাজ চলছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো মেরামতের কাজ চলছে।

প্রাণ ফিরেছে কক্সবাজারে : ঘূর্ণিঝড় মোকার প্রভাবে কক্সবাজারের মূল ভূখণ্ড নিরাপদেই ছিল। কিন্তু আতঙ্ক আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে দুদিন ধরে অনেকটা থমকে ছিল এখানকার মানুষদের জীবন। তবে গতকাল সকাল থেকে অনেকটা প্রাণ ফিরেছে কক্সবাজার সদরে। সকাল থেকে এখানকার আবহাওয়া রবিবারের ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ কড়া রোদ, হালকা বাতাস সবকিছু মিলে এক স্বাভাবিক কক্সবাজার দেখা গেছে গতকাল।

কক্সবাজার শহরের বাসিন্দা কাজী শাহাদাতুল ইসলাম বলেন, সবাই আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম কিনা কি হয়ে যায়। শুকরিয়া তেমন বড় ক্ষতি হয়নি। এতে কক্সবাজারের হোটেল ব্যবসায়ীদের মনে স্বস্তি ফিরেছে। কারণ ৯১ সালের বন্যায় মাস খানেকের মতো এই এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। এবার তেমন প্রভাবই পড়েনি। এদিকে রবিবার বন্ধ থাকলেও গতকাল সোমবার সকাল থেকে কক্সবাজারে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। সৈকতে পর্যটকদের ভিড়ও দেখা গেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App