×

সারাদেশ

শান্তিগঞ্জে এখনো হয়নি প্রকৃত কৃষকদের নামের তালিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৩, ১১:১২ এএম

শান্তিগঞ্জে এখনো হয়নি প্রকৃত কৃষকদের নামের তালিকা

ছবি: সংগৃহীত

ধানের কাঙ্ক্ষিত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলাসহ সুনামগঞ্জের সব হাওরেই এবছর ধানের ফলন ভালো হয়েছে। নির্বিঘ্নে সব ধান ঘরে তুলেছেন কৃষকেরা। স্বপ্নের সোনালী ফসল ঘরে তুলতে পেরে শান্তিগঞ্জের কৃষক-কৃষাণীর চোখেমুখে ফুটেছিলো রাজ্যের হাসি। কিন্তু সেই ধান বিক্রি করতে এসেই সেই হাসি আর থাকে না। মুখ মলিন হয়ে যায় কৃষকদের। কারণ ধানের কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না তাঁরা। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২ থেকে ৩শ টাকা কম মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে কষ্টে ফলানো ধান।

অধিকাংশ কৃষক সরকারের কাছে সরাসরি ধান বিক্রি করতে পারেন না ‘সিস্টেম’ জটিলতার কারণে। এজন্য কাঙ্ক্ষিত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। মাঝখানে ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন ধানের ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা।

উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে এখনো ধান ক্রয় শুরু না হাওয়ায় সুযোগ নিচ্ছেন ফড়িয়াবাজরা। কবে থেকে ধান ক্রয় শুরু হবে, কতজন কৃষক ধান বিক্রি করতে পারবেন কিংবা কত টাকা দরে কেনা হবে ধান এমন কোনো তথ্য নেই শান্তিগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তার কাছে।

তবে উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক অসীম কুমার তালুকদার জানান, ৭ মে থেকে দেশের বিভাগীয় পর্যায়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সরকারিভাবে ধান কেনার উদ্বোধন করেন। আমরা আশা করছি, এই সপ্তাহের মধ্যে বরাদ্দপত্র হাতে পাবো। বরাদ্দপত্র হাতে পেলেই উপজেলা পর্যায়ে ধান কেনা শুরু করতে পারবো। এবছর ধানের প্রতি কেজি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ টাকা। প্রতি মণ ধান ১২ শ টাকা। ১৮শ ১৭ মেট্রিকটন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি আমরা। এ বছর খুব সহজেই এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।

তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের কাছে ধান বিক্রয়াগ্রহী কৃষকদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তারা তালিকা দিলে সে অনুযায়ী কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করবো।

ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারিভাবে আরও সহজ প্রক্রিয়ার ধান কেনা-বেচার দাবি আছে কৃষকদের এমন প্রশ্নে এই খাদ্য পরিদর্শক বলেন, এটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানে আমাদের বলারও কিছু নেই। একটা সময় সাময়িক ক্রয় কেন্দ্র (টিপিসি) বলে একটা বিষয় চালু ছিলো। যার মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে সরাসরি ধান কেনা হতো। এখন আর সেটা নেই।

উপজেলার একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, শান্তিগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের হাওরপাড়ের অধিকাংশ কৃষকরাই নিম্ন আয়ের। তাঁরা দফায় দফায় ধারদেনা করে চাষাবাদ করেন। প্রত্যেককেই ধান কেটে ঋণ পরিশোধ করার কথা বলে এসব টাকা ধার করেন তাঁরা। সে সুযোগে ধার দেওয়া অতিমুনাফা লোভী অসাধু ব্যক্তিরা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক কম মূল্য নির্ধারণ করে টাকা ধান দেন। নিরুপায় হয়ে তাদের নির্ধারণ করা মূল্যে অগ্রিম ধান বিক্রি করতে হয় কৃষকদের। আবার বৈশাখ মাসে গ্রামে গ্রামে ঘুরে আরেকদল ফড়িয়াবাজরা আছেন যারা কমমূল্যে ধান কিনে থাকেন। সরকার নির্ধারিত মূল্য যেখানে ১২শ টাকা সেখানে তারা ধান কিনেন ৮শ থেকে ১ হাজার টাকায়। ওজনে বেশি নিতে সনাতনী পদ্ধতিতে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে ধান ক্রয়ের চেষ্টা করেন ফড়িয়ারা।

কৃষকদের মাঝে কিছুটা সচেতনতা বাড়ায় তাঁরা এখন ডিজিটাল ওজন মাপার মেশিন ছাড়া ধান বিক্রি করেন না। হাওরের খলায় খলায় (ধান শুকানোর জন্য বিশেষ উঠান) গিয়ে নিজস্ব মানুষ দিয়ে ধান ক্রয় করেন ফড়িয়াবাজরা। কোনো কোনো কৃষক নিকটস্থ রাইস মিলেও ধান বিক্রি করে থাকেন। ধানকে ক্রেতা-বিক্রেতারা দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। বড় এবং ছোট ধান। বড় ধানের মধ্যে আছে হিরা, পান্না, ধনকরাজ ইত্যাদি। যা ৮শ থেকে ৮শ ৫০ টাকা দরে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে। ছোট ধান বিক্রি হচ্ছে ৯শ থেকে ১ হাজার টাকা দরে। ছোট ধানের মধ্যে ব্রি-২৮, ২৯, শক্তি-২, আফতাব, ৮৮ এবং ৮৯ জাতের ধান বেশি বিক্রি হচ্ছে।

কৃষকরা জানান, সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করে দেন সে মূল্যে প্রান্তিক কৃষকদের ৯৫ শতাংশ মানুষই ধান বিক্রি করতে পারেন না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাঁরা ফরিয়াদের কাছে কম মূল্যে ধান বিক্রি করেন। সরকারিভাবে ধান বেচতে গেলে নানান জটিলতা, অবৈধ লেনদেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে হয়রানি, দ্রুত টাকা না পাওয়া ইত্যাদি সমস্যা থেকে যায়৷ যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে সহজ প্রক্রিয়ার ধান ক্রয় করা হতো তাহলে কৃষক-সরকার দুই পক্ষই খুব বেশি উপকার হতো। এখন তো বেশি লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ধান ব্যবসায়ীরা।

পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের টাইলা গ্রামের কৃষক সাজিদুর রহমান বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় রজনীগঞ্জ (টানাখালী) বাজারে একজন কৃষক আমার সামনে ৫ মণ ধানের দাম নিয়েছেন ফড়িয়া ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। ছোট-লম্বা ধান ৯শ টাকা এবং বড় ধান ৮শ ৫০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করেছেন তিনি। এভাবেই ধানের কেনা বেচা হচ্ছে আমাদের এ দিকে। শুনেছি সরকারি দর ১২শ টাকা। এ দাম তো আমরা পাই না। যখন এসব শুনি তখন ধান তুলে যতটা খুশি হই বিক্রি করে ততটা খুশি হতে পারি না। মণ প্রতি ২শ-৩শ টাকা কম পাচ্ছি আমরা।

শিমুলবাক ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের কৃষক মো. জিয়া উদ্দিন ও পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের উমেদনগর (লাউগাঙ) গ্রামের কৃষক, গীতিকবি আফজল হোসেন বলেন, যদিও গত বছরের তুলনায় ধানের দাম কিছুটা বেশি পাচ্ছি তবে এ দাম সরকারি মূল্য থেকে ২/৩শ টাকা কম।অধিকাংশ কৃষকেরাই অভাবী। অন্যের কাছ থেকে ধারদেনা করে চাষাবাদ করেছেন। তাঁদের টাকার একটা চাপ থাকে। সেই চাপ সামাল দিতেই হাতের কাছে সহজ প্রক্রিয়া দাম কিছু কম পেলেও বিক্রি করে দেন। তবে সরকার যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নগদমূল্যে ধান কিনতো তাহলে সরকারও প্রচুর ধান সংগ্রহ করতে পারতো আমরাও বেশি লাভবান হতাম।

পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামের কৃষক লিয়াকত আলীও ইউনিয়ন পর্যায়ে সহজ প্রক্রিয়ায় সরকারিভাবে সরাসরি ধান খরিদের দাবি জানান।

শান্তিগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তা সোহায়েল আহমদ বলেন, ধান ক্রয় সংক্রান্ত অফিসিয়াল কোনো নির্দেশনা এখনো আমি পাইনি। কবে থেকে ধান কেনা শুরু হতে পারে তা-ও জানা নেই এই কৃষি কর্মকর্তার। ধান বিক্রয়াগ্রহী প্রকৃত কৃষকদের নামের তালিকা এখনো প্রস্তুত হয়নি, তবে অচিরেই তা তৈরি হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App