×

সারাদেশ

কৃষকদের ভুলিয়ে মাটি কাটছেন ইটভাটার মালিকরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৫:৩৪ পিএম

কৃষকদের ভুলিয়ে মাটি কাটছেন ইটভাটার মালিকরা

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় কৃষকদের ‘লোভনীয় প্রস্তাব’ দিয়ে ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছেন মালিকরা। ছবি: ভোরের কাগজ

কৃষকদের ভুলিয়ে মাটি কাটছেন ইটভাটার মালিকরা
কৃষকদের ভুলিয়ে মাটি কাটছেন ইটভাটার মালিকরা

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ মাঠের ফসলি জমির উর্বর অংশ কেটে ইটভাটা মালিকেরা নিয়ে যাচ্ছে ইট তৈরিতে। এ জন্য ভাটা মালিকরা ‘লোভনীয় প্রস্তাব’ দিয়ে দুর্বল করে তুলছেন কৃষকদেরকে। এই এলাকার বেশিরভাগ ইটভাটায় এভাবে ফসলি জমির মাটির উর্বর অংশ পুড়িয়ে ইট তৈরি হচ্ছে। প্রশাসন মাঝে মধ্যে হানা দিলেও অদৃশ্য কারণে তা বন্ধ হচ্ছে না।

সরেজমিনে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের দাপনা গ্রামের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ওই গ্রামের হাসেম আলীর ফসলি জমিতে ভেড়ানো রয়েছে মাটি কাটা ভেকু। পাশেই পরপর ভেড়ানো রয়েছে ছয়টি মাটি টানার ট্রাক্টর। এই ট্রাক্টরে মাটি ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলাকান্দর গ্রামের একটি ইটভাটায়। একটু এগিয়ে বলাকান্দর মাঠে দেখা যায় অন্য আরেকটি ফসলি জমির মাটিও কেটে নেয়া হচ্ছে কাছাকাছি একই ইটভাটায়। এগিয়ে এসে মস্তবাপুর মাদ্রাসার পাশের জমি থেকেও মাটি কেটে ট্রাক্টরে ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য আরেকটি ইটভাটায়। একই দিন উপজেলার আরও অনেক মাঠে ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব গ্রামের মাঠের মধ্যেই ফসলী জমির মাটি কেটে একইভাবে ট্রাক্টরে ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্থানীয় নিকটবর্তী ইটভাটাগুলোতে। এতে জমির উপরি নরম মাটি আর ক্ষেতে থাকছে না। মাটি বহনে মাঠে মাঠে কয়েক শত ট্রাক্টর নামানো হয়েছে। যে ট্রাক্টরগুলোর মধ্যে কিছু স্থানীয় মাটি ব্যবসায়ীরা মালিক। তবে বেশির ভাগই আশপাশের যশোর, নড়াইল, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা,কুষ্টিয়া জেলা থেকেও মাটি কাটা ভেকু ট্রাক্টর ও শ্রমিক বিশেষ চুক্তিতে এনেছেন ভাটা মালিক ও মাটি ব্যবসায়ীরা। আবার মাটি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ নিজেরা ট্রলি কিনে নিয়েছে। তারা বিশেষ করে আমন ধান কাটার পর শুকনো জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করে থাকে।

বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের অভিযোগ, কালীগঞ্জ উপজেলার মাঠে মাঠে এখন মাটি কাটা ভেকু। এই ভেকু দিয়ে নির্ভয়ে ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগ অন্য জেলা থেকে ঘণ্টা চুক্তিতে মাটি ব্যবসায়ী ও ভাটা মালিকেরা এনেছেন। তারা জানান, বেশিরভাগই আশপাশের মাগুরা,যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, পাবনা জেলা থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। সাঙ্গে আনা হয়েছে মাটি টানা টাক্ট্রর ও শ্রমিক। স্থানীয় মাটি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইটভাটায় মাটি দিচ্ছেন তারা। প্রভাবশালী হওয়ায় কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না তারা।

নলডাঙ্গা এলাকার মাটি ব্যবসায়ী পিকুল হোসেন জানান, তিনি প্রতি ট্রাক্টরের ট্রলি মাটি বিক্রি করছেন ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায়। একটু দূর হলে আরও বেশি। তিনি বলেন, ইটভাটায় তিনি মাটি দেন না। শুধুমাত্র বাসা বাড়ি নির্মাণের সময়ে কেউ আসলে তাদের কাছে মাটি বিক্রি করে থাকেন। অথচ কয়েকদিন আগে ফসলী ক্ষেত থেকে মাটি কাটার সময়ে প্রশাসনের কাছে ধরা খেয়েছে।

উপজেলার ঈশ্বরবা গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী এনামুল মিয়া জানান, তারা তাদের এলাকায় মাটির ব্যবসা করেন। প্রতি টলি মাটি ৮০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। দুরত্বে হলে দাম আরও একটু বেশি। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে মাটির ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি।

এদিকে, এ বিষয়ে উপজেলা কয়েকটি ইটভাটার মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি।

কালীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, আমি এ উপজেলাতে যোগদানের পর গত এক বছরে খবর পেলেই মাটি কাটা বন্ধ করতে চলে গেছি। এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক স্পটের মাটি কাটা বন্ধ করেছি। সম্প্রতি প্রয়োজন মত ১১টি স্পটে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জরিমানার আওতায় এনেছি।

প্রশাসনের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, কেউ কেউ জেলা প্রশাসক মহোদয়ের অনুমতিক্রমে গর্ত জায়গায় পুকুর কাটছেন মাছ চাষের জন্য। সেগুলো শুধু ছাড় দেয়া হচ্ছে। তবে সেগুলো অবশ্যই ফসলি জমি নয়। আর মাছচাষও কৃষিকাজের একটি অংশ।

যশোরে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মাঠে মাঠে মাটি কাটার উৎসব চলাটা দুঃখজনক। তিনি বলেন কৃষক পর্যায়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তাদের নেই। তারপরও তাদের দপ্তরের যখন কৃষকদের নিয়ে কর্মশালা হয় তখন তারা কৃষকদেরকে জমির টপ সোয়েলের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করেন।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন (কৃষি) মহাপরিচালক (ঢাকা) মো. কামরুজ্জামান এ বিষয়ে ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশের মাটিতে সোনা ফলে। যে কারণে মাটি সবচেয়ে বড় সম্পদ। এ সম্পদ টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। তিনি বলেন, মাটির ওপরের যে জৈব উপাদানে ভরা টপ সোয়েল ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই প্রয়োজন। এমন উর্বরাক্ষম মাটি তৈরি একদিনে হয়নি। হাজার বছর পর মাটির উপরিভাগ এমন অধিক উৎপাদনক্ষম ও উর্বরা হয়েছে। সেটা অসচেতনতায় হোক অথবা কারও সামান্য কিছু অর্থের লোভে হোক বিক্রি করা হয়। তা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার মত। আর এভাবে চলতে থাকলে তো একদিন আমাদের মাটি উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। ফলে মাটি রক্ষায় আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App