×

রাজধানী

গুলিস্তানের ১৫ মার্কেটে চাঁদার রাজত্ব : নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৩, ০৮:৩৩ এএম

গুলিস্তানের ১৫ মার্কেটে চাঁদার রাজত্ব : নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট
রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ছোটবড় মিলিয়ে ১৫টি মার্কেট রয়েছে। এসব মার্কেট ঘিরে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট, যারা গত তিন দশক ধরে এসব মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ করছে। সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন এসব মার্কেটের দোকান থেকে নানা অজুহাতে প্রতি মাসে তোলা হয় কোটি কোটি টাকা। সিন্ডিকেট, রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রশাসনের কিছু সদস্যসহ কয়েকজন মিলে ভাগবাটোয়ারা করে এই টাকা পকেটস্থ করছেন। আর দুই দশক ধরে সবকটি মার্কেট পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে ঘুরেফিরে আছেন একই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এক মাকের্টের সভাপতি আরেক মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক বা সহসভাপতির দায়িত্বে আছেন। নিজেরা মনের মতো করে সাজিয়েছে পুরো এলাকার মার্কেট পরিচালনা পর্ষদ। এখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে একাকার। মিলেমিশে ভাগ করে খাচ্ছেন মার্কেট ও ফুটপাতের টাকা। কর্তৃত্ব ও খবরদারি সবই তাদের হাতে। গুলিস্তানের বিরাট এলাকায় রাস্তার পাশের ফুটপাতের ২৪টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা চাঁদা উঠছে। এই টাকা ভাগবাটোয়ারা করছে ‘সিন্ডিকেট’। সিন্ডিকেটের প্রধান একজন সংসদ সদস্য। সিন্ডিকেটের ভাবখানা এমন- তারা কিছুই জানেন না। আদতে তাদের হুকুম ছাড়া গুলিস্তানের ১৫ মার্কেটে কিছুই হয় না। সবই হয় তাদের ঈশারায়। আর চাঁদার টাকার ভাগ যায় ঢাকার একজন সংসদ সদস্য, মাদারীপুর জেলার একজন সংসদ সদস্য, চাঁদপুরের একজন সংসদ সদস্য, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগের একজন বহিষ্কৃত নেতার কাছেও। জানা গেছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানায় থাকা বঙ্গবাজার, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট, ঢাকা ট্রেড সেন্টার (উত্তর), ঢাকা ট্রেড সেন্টার (দক্ষিণ), পীর ইয়ামিনী মার্কেট, খদ্দের বাজার হকার্স মার্কেট, গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার, রেলওয়ে সুপার মার্কেট, সুন্দরবন মার্কেট, সুপার মার্কেট-১, জাকের সুপার মার্কেট, সিটি প্লাজা, নগর প্লাজা ও আনন্দবাজার কাঁচাবাজার। আর ব্যক্তি মালিকানায় আছে এনেক্সো টাওয়ার, রমনা ভবন ও সালিমাবাদ ভবন। সেখানেও আছে একই সিন্ডিকেটের ছায়া। গুলিস্তান ঘিরে সরকারি অর্থায়নে গড়ে ওঠা ১৫টি মার্কেটে খবরদারি করছেন কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সহসভাপতি মোজাম্মেল হক মজু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য নাজমুল হুদা, শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিএম আতিকুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মনোয়ার হোসেন মনু, ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি জহিরুল ইসলাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হাজি আব্দুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন। এরাই মূলত সিন্ডিকেট। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানায় নির্মাণাধীন গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের বেইজমেন্টে ৪০৮টি দোকান রয়েছে। দুই মাস আগে দোকান রং করা ও বৈদ্যুতিক তার পরিবর্তনের কথা বলে দোকান প্রতি ৪০ হাজার টাকা করে মালিকদের কাছ থেকে নিয়েছে সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে, কাজ না করে মার্কেট পরিচালনা কমিটির নাম করে জিএম আতিকুর রহমান, মনোয়ার হোসেন মনু ও আবু হান্নান সিদ্দিকী মিলে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা পকেটস্থ করেছেন। এদের মধ্যে আতিক পীর ইয়ামিনী মার্কেট, রেলওয়ে সুপার মার্কেট, খদ্দের বাজার হকার্স মার্কেট, বঙ্গবাজার, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট ও ঢাকা ট্রেড সেন্টার (উত্তর) এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। আগুনে পোড়া বঙ্গ কমপ্লেক্সের ২৯৬১টি দোকান পরিচালনায় ছিল সিন্ডিকেটই সর্বেসর্বা। তাদের হাতের তুড়িতে সব হয় সেখানে। সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ না করে গুলিস্তান এলাকায় কোনো ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারেন না, এটা ওপেন সিক্রেট। পুড়ে যাওয়া স্থানে বহুতল ভবন করে নতুন মার্কেট নির্মাণের যে প্রস্তুতি চলছে সেখানে দোকান বরাদ্দে সিন্ডিকেট চেষ্টা তদবির শুরু করেছে বলে জানা গেছে। অপরদিকে বায়তুল মোকারমের সামনে থেকে ২০ নম্বর ওয়ার্ডের শেষ সীমানা সুন্দরবন মার্কেট পর্যন্ত এলাকার ফুটপাতে নিত্যদিনের চাঁদাবাজির কথা সবার জানা থাকলেও সবকিছু চলছে প্রকাশ্যে। ২৪টি পয়েন্ট থেকে সব মিলিয়ে প্রতিদিন আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। দোকানভেদে ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, আবু হান্নান সিদ্দিকী ও মনোয়ার হোসেন মনু লোক দিয়ে ফুটপাত থেকে চাঁদা তুলে ভাগবাটোয়ারা করছেন। ভাগ যাচ্ছে পুলিশ এবং প্রশাসনের কাছেও। অভিযোগ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, তিনি আগে বিভিন্ন মার্কেট পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে থাকলেও এখন নেই। দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। গুলিস্তানে কোনো সিন্ডকেট নেই দাবি করে তিনি বলেন, মার্কেটগুলো আলাদা আলাদা কমিটি পরিচালনা করে থাকে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন মার্কেটের দোকান বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সেখানে হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। মার্কেটগুলো নিয়ম মতো চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেলোয়ার হোসেন দিলু ৩-৪টি মার্কেট নির্মাণে অনিয়ম করলে সরকার সেগুলো ভেঙে দিয়েছে। দিলু ব্যবসায়ীদের সুনাম নষ্ট করেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বর্তমানে গ্রেপ্তার এড়াতে মালয়েশিয়ায় পলাতক আছেন। শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিএম আতিকুর রহমান বলেছেন, তার বিরুদ্ধে উঠা সব অভিযোগ মিথ্যা। তিনি কোনো সিন্ডিকেটে নেই। মার্কেটে তার কোনো দোকান নেই, তিনি কোনো কমিটিতেও নেই। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের দোকান মালিকরা টাকা তুলে সংস্কার কাজ করেছেন বলে জানান তিনি। ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মনোয়ার হোসেন মনু বলেছেন, তিনি কোনো সিন্ডিকেটে নেই। সব অভিযোগ ভুয়া। তবে ফুটপাত থেকে লাইনম্যান ও পুলিশ টাকা তুলে বলে দাবি করেন তিনি। অন্যদিকে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওই এলাকার (ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড) কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন বলেছেন, গুলিস্তানের সবকটি মার্কেট ও ফুটপাতে চাঁদাবাজি হয় এমন মৌখিক অভিযোগ করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় এবং দোকান হারানোর ভয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ না করায় কিছু করা যাচ্ছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App