আমরা যারা সমালোচনা করি আমাদের তেমন কোনো যোগ্যতা নেই। তবে যাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করি সেই আলোচিত বা সমালোচিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা নিঃসন্দেহে যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন এলিট গুণমান স্ব এবং সুনামধারী জন এবং গণ প্রতিনিধি, যারা মুরব্বিদের বিশেষ আশীর্বাদে সমাজ তথা অভাগা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন এবং লালন করছেন। অতএব সমালোচিত হতে বহু যোগ্যতার দরকার যা বাংলাদেশের আমলা থেকে কামলাদের রয়েছে সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
সন্দেহ একটাই সেটা হলো সারাদেশে কুকুরের যে উৎপাত বেড়েছে এবং তারা দেশের শহরগুলোতে হেগে-মুতে নান্ডিভাস্টি করছে, এই অপ্রিয় সত্য ঘটনাটি জানার যোগ্যতাটুকু দেশের এলিট শ্রেণী এবং যোগ্য ব্যক্তিদের আছে কি? প্রশ্ন হতে পারে থেকে লাভ কী? ঘুষ খাওয়া আর গু-মুত খাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তাছাড়া পেটে এসব গেলে সমস্যা নেই। কারণ পেটের প্রতিরোধ দমন করার মতো ক্ষমতা আছে। কিন্তু নাকের ভেতর দিয়ে যখন ফুসফুসে ঢুকছে তার মানে তখন সেটা সরাসরি রক্তে চলে যাচ্ছে, সেটা নিশ্চিত খুবই ভয়ঙ্কর!
সদ্য বাংলাদেশ ভ্রমণ করে ফিরেছেন একজন আমেরিকা প্রবাসী তিনি ফ্লোরিডার বাসিন্দা। আমি তার বাংলাদেশ ভ্রমণ সম্পর্কে কিছুটা অবগত ছিলাম। তাকে একটি টেক্সট মেসেজ দিয়ে রেখেছিলাম যেন সময় করে আমাকে নক করে। কিছুক্ষণ যেতেই ভদ্রলোক ফোন করেছেন, জিজ্ঞাসা করলাম বাংলাদেশ কেমন লেগেছে। বললেন এখনও কিছুটা অসুস্থ, শরীরে জ্বর নেই তবে বেশ কাশি, কাশির সাথে বেশ অস্বস্তিকর পরিবেশ মনের মধ্যে দোল দিচ্ছে। কথায় বেশ বিষণ্ণ মনে হলো সাথে বেশ অনুশোচনা করছেন কেন তিনি রীতিমতো মাস্ক ব্যবহার করেননি রাস্তা-ঘাটে চলাকালীন!
আমি জিজ্ঞেস করলাম পোস্ট কভিড হয়েছে কী-না? উত্তরে বললেন না, তবে কুকুরের গু-মুত, ধুলো এবং বাকি সব আবর্জনা একসঙ্গে পাউডার হয়ে নাকে ঢুকেছে। যার ফলে আমি এখনও কিছুটা অসুস্থ। তবে আশা করছি সত্বর সুস্থ হয়ে উঠবো। ভদ্রলোক বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে পুরো ঘটনাটি জানালেন দেশের শহরগুলোর পরিবেশ। ভদ্রলোক সম্ভবত ঢাকা, দিনাজপুর, যশোর ঘুরেছেন জানতে পারলাম। তার বর্ণনায় বাংলাদেশের দূষণ কিছুটা ভিন্ন বিশ্বের অন্যান্য দূষিত দেশগুলোর তুলনায়।
তিনি বললেন বাংলাদেশের শহরে ভোর রাতে বস্তির মানুষ, দিনমজুরসহ নানা ধরনের পেশার মানুষ ঘুম থেকে উঠে রাস্তার পাশেই হাগা-মুতার কাজ সেরে নেয়। পরে শহরের কুকুরগুলো সেগুলো খায় এবং কুকুরও যেখানে সেখানে হেগে-মুতে রাখে। এরপর শুরু হলো যানবাহনের চলাচল, শুরু হলো প্রচণ্ড রৌদ্র, মাঝে মধ্যে বৃষ্টি। রিকশা এবং গাড়ির চাকার তলে মানুষ এবং কুকুরের সেই গু-মুত চাপাচাপির ফলে ছাতুতে পরিণত হয়ে ধুলোর সাথে মিশে নাকে মুখে ঢুকে পড়ে। এটা সবার ক্ষেত্রেই হচ্ছে কিন্তু যারা নিয়মিত শহরে বসবাস করছে তাদের এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু আমি ছিলাম নতুন তাই অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু মানিয়ে নিতে পারিনি।
ভদ্রলোক গুছিয়ে গাছিয়ে কথাগুলো বললেন আমি নিস্তব্ধ নীরবে তার কথাগুলো শুনলাম এবং আমার ভাবনায় আবারও দোলা দিয়ে গেল উপরের কথাগুলো— নাকের ভেতর দিয়ে যখন ফুসফুসে ঢুকছে তার মানে তখন সেটা সরাসরি রক্তে চলে যাচ্ছে, যা নিশ্চিত খুবই ভয়ঙ্কর? ও ভালো কথা, ভদ্রলোক আমার ছোটবেলার স্কুলটির পাশ দিয়ে যেতে পথে ছোট্ট একটি ভিডিও করে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। আমি বেশ অবাক হয়ে ভাবতে শুরু করি তখন! কী ব্যাপার সে হঠাৎ বাংলাদেশে তাও আমার গ্রামের স্কুলের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে? গাড়িতে চলন্ত অবস্থায় ছবি তুলেছেন তিনি।
কিছুদিন আগে আমি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় আমার সেই স্কুলের শতবর্ষ পূর্ণ হবে ২০২৪ সালে তার উপর একটি কলাম লিখেছিলাম। ভদ্রলোক ঘটনাটি জানতেন, হয়তো সেই কারণেই যশোর থেকে ঢাকা যেতে পথে নহাটার (মাগুরা জেলাধীন) পাশ দিয়ে যাবার সময় স্কুলের দৃশ্যটি তুলে ধরেছিলেন। সেই বিষয়টি জানতেই মূলত আমি তাকে নক করেছিলাম।
আমি চল্লিশ বছর দেশ ছেড়েছি। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে সেখানে পড়েছি। স্কুলের পাশ দিয়ে চলে গেছে ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’, ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট শেরশাহ কর্তৃক নির্মিত বাংলার সোনারগাঁও থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত সুদীর্ঘ সড়ক। ব্রিটিশ আমলে চলাচলের সুবিধা এবং ডাক বিভাগের উন্নতির উদ্দেশ্য সড়কের সংস্কার করে কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। এ সময় এই সড়কটির নাম দেওয়া হয় ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’। ব্রিটিশ শাসনের সময়কালের সেই কাঁচা রাস্তাটি দেশ স্বাধীনের পর পাকা হয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ফরিদপুর থেকে যশোর বেনাপোল হয়ে ভারতে ঢুকেছে।
নহাটার পাশ দিয়ে চলমান রাস্তাটির নাম তখন ছিল “গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড” যা বর্তমান আমার চাচা বীর প্রতীক মরহুম ইয়াকুব মিয়া রোড নামে পরিচিত। যাইহোক সেই ঐতিহাসিক রাস্তার পাশে বিশিষ্ট জ্ঞানতাপস ও বিদ্যোৎসাহী বাবু শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্যের উদ্যোগে স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের দান ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ ও অদম্য প্রচেষ্টার ফলে ১৯২৪ সালে স্থাপিত হয় নবগঙ্গা বিধৌত মাগুরা জেলার প্রত্যন্ত জনপদ নহাটায় মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের একটা উজ্জ্বল বাতিঘর, নহাটা স্কুল, সেখানে আমি পড়েছি। আমার সময়ে স্কুলটিতে পাঠদান হতো একটি উন্মুক্ত পরিবেশে যা এখন ভিডিওতে দেখে মনে হলো জেলখানায় পরিণত হয়েছে।
স্কুলের মধ্যে আদৌ বিশুদ্ধ আলো বাতাস প্রবেশ করে কিনা সেটাও সন্দেহ। শুনেছি দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে তবে আমেরিকান প্রবাসীর ভ্রমণের বর্ণনা আর ভিডিওটি দেখার পর মনের মাঝে ফুলে থাকা বেলুনটি মুহূর্তে চুপসে গেল! ঠিক সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পরিচিত ছেলের একটি কমেন্ট নজর কেড়ে নিল। তখন তাকে লিখলাম— তোমার একটা কমেন্ট পড়লাম, লিখেছ বাংলাদেশের বিমানবন্দরে নতুন থার্ড টার্মিনালের নকশা করেছে রোহানি বাহরিন। এই একটা মেয়ে দেশের ২৪ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ারকে হারিয়ে দিয়ে গেল।
প্রশ্ন হচ্ছে এতগুলো বুয়েট, রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট আপনাদের, এতো টাকা ভর্তুকি দিয়ে জনগণ তাদের আশা নিয়ে পড়াচ্ছে। তারা কই? তারা কী শিখল? একটা মেয়ের সমান বাংলাদেশের ২৪ লাখ ইঞ্জিনিয়ার না পরাজিত হয়ে গেল? বাংলাদেশের একটা মেগা প্রকল্পের নকশা কিংবা কারিগরিতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকদের চুল পরিমাণ অবদান নেই। আমরা তাহলে এতদিন ধরে কী বা কাদের তৈরি করেছি? এসব ইঞ্জিনিয়ার আসলে কী কাজ করছে তাও ক্লিয়ার হওয়া উচিত।
তবে অপ্রিয় সত্য কথা যখন তুললেই তবে পুরোটা কেন তুললে না? নাকি ইচ্ছে করে রেখে দিয়েছো ভেবে হয়তো অন্য কেউ বাকি অংশটুকু তুলে ধরবে? এই একই প্রশ্ন যেমন এতগুলো মেডিকেল কলেজ আমাদের, এতো টাকা ভর্তুকি দিয়ে জনগণ তাদের আশা নিয়ে পড়াচ্ছে। তারা কই? তারা কী শিখলো? প্রতিদিন কারো কিছু হলেই ভারতে চিকিৎসার জন্য ধাওয়া করে, বাংলাদেশের লাখো লাখো ডাক্তার এবং শতক খানেক হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের একটা বড় নেতার চিকিৎসা করার মতো এসব মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের সামান্য পরিমাণ দক্ষতা নেই!
তা যদি না থাকে তাহলে এতদিন ধরে আমরা কী বা কাদের তৈরি করেছি? যাইহোক তোমাকে ধন্যবাদ। সে উত্তরে লিখেছে, “বাকিটা আপনি লিখেন ভাই। আমি মানুষের মাথায় প্রশ্ন একে দিই, বিস্তারিত বলি না”। তার শেষের কথাটি মনে ধরেছে, তাই আমি কুকুরের গু-মুত নিয়ে যা লিখেছি আশা করি সবার মাথায় প্রশ্ন একে দিতে পেরেছি। সেই সাথে ভাবছি,—হায়রে অভাগা বাংলাদেশ; তোর অর্থে আমেরিকা, কানাডা, দুবাই, সিঙ্গাপুর, বেগমপাড়া হয়, অথচ তুই বেচারা গোধূলির লগনে কুকুরের গু-মুত মিশিয়ে পর্যটকদের অসুস্থ করে নতুন এক মর্মান্তিক ইতিহাস সৃষ্টি করছিস?
প্রিয় দেশ! আমি তোকে দোষী করছি না, দোষ আমার পোড়া কপালের, তা না হলে আজ তোর এই দশা হবে কেন? আমি হতাশ বা দুঃখ পেলেও খুশি হলাম জেনে তুই এখনও সংগ্রাম করে চলছিস। আমি অভাগা সমালোচক তোর সমালোচনা করছি কারণ সমালোচনার যোগ্যতা তো তুই-ই রাখিস। তোর বুক চিরে শোষণ করেছে ব্রিটিশ, পরে পাকিস্তান আর এখন তোরই দুর্নীতিবাজ সন্তানেরা। কে সামলাবে তাদের এখন? ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, দুর্নীতিবাজদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।