×

মুক্তচিন্তা

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস-২০২৩ > ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন : প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১৩ এএম

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস-২০২৩ > ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন : প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন

এ বছরের সেøাগান হচ্ছে- ‘Know your risk, Know your response.’ বাংলায় ভাবানুবাদ করা হয়েছে, ‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।’ এ প্রতিপাদ্য থেকে এটা স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এবার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের সাম্প্রতিক সময়ের তথ্যমতে, পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যু হয় এবং দুজন নতুন ডায়াবেটিস রোগী শনাক্ত হয়! ১৯৯১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হবে। ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালনের আরো একটি কারণ হলো এদিনের ফ্রেডরিক ব্যান্টিং জন্মগ্রহণ করেন। যিনি তার সহযোগী চার্লস বেল্টকে সঙ্গে নিয়ে অধ্যাপক ম্যাকয়িডের গবেষণাগারে ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণের মহৌষধ ইনসুলিন আবিষ্কার করেন। ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি মহামারি রোগ হিসেবে চিহ্নিত এবং এটি সারাজীবনের রোগ। নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা অনেক। এই দিবসটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়াবেটিস রোগের লক্ষণ, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যবস্থা সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা। উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৃদ্ধির হার বেশি। ২০০৩ সালে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগী ছিল ১৯ কোটি। আগামী ২০৩০ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ডায়াবেটিসকে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সুতরাং প্রতিদিন ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে ডায়াবেটিক রোগীদের নানা ধরনের জটিলতা। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিসকে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। তা হচ্ছে- দৈনন্দিন জীবনে আমাদের শারীরিক সক্রিয়তা কম এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ না করা। ডায়াবেটিস মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী রোগ; যা ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। আইডিএফ ডায়াবেটিস এটলাস ডায়াবেটিসের বৈশ্বিক প্রভাব সম্পর্কে সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান এবং তথ্য দিয়েছে, তাতে দেখা যায়- ২০২১ সালে ৫৩ কোটি ৭ লাখ মানুষ (প্রতি ১০ জনে ১ জন) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৪ কোটি ৩ লাখে এবং ২০৪৫ সালে ৭৮ কোটি ৩ লাখে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২৪ কোটি মানুষ (প্রতি ২ জনে ১ জন) জানেন না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ১২ লাখেরও বেশি শিশু ও কিশোর (০-১৯ বছর) টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০২১ সালে বিশ্বের ৬৭ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিসের কারণে, যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বংশগত কারণ ছাড়াও নগরায়ণ ও পরিবর্তিত জীবনধারণের কারণেই ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের প্রায় অর্ধেক পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এমনকি অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে শিশু অপুষ্টির শিকার হলে এবং সেই শিশু পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর অতিরিক্ত ওজন হলে তার ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি থাকে। বর্তমানে নগরায়ণের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তবে বৃদ্ধির এই হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে বেশি। ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে প্রতি বছর অসংখ্য মহিলা ডায়াবেটিসের শিকার হচ্ছেন এবং ডায়াবেটিস নিয়ে শিশু জন্ম দিচ্ছেন অথবা নবজাতক শিশুর বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিচ্ছে। প্রতিটি গর্ভবতী মা যদি গর্ভধারণের পূর্বেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সন্তান জন্ম দিতে পারেন, তবে সন্তান সুস্থভাবে জন্ম দিতে পারবেন এবং মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা দিতে বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে সারাদেশে ‘গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা কেন্দ্র’ খোলা হয়েছে, যেখানে নির্ধারিত সময়ে বিনামূল্যে গর্ভধারণ-পূর্ব পরামর্শ এবং স্বল্পমূল্যে গর্ভধারণ সংক্রান্ত সেবা পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রসবকালীন নারী ও শিশুমৃত্যুর হার যেমন কমানো সম্ভব হবে, তেমনি নারীসহ আগামী প্রজন্মকেও ডায়াবেটিসের ভয়াবহ প্রকোপ থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব হবে। ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- কায়িক পরিশ্রম না করা মোটা বা স্থূলকায় হয়ে যাওয়া অতিমাত্রায় ফাস্টফুড খাওয়া ও কোমল পানীয় (সফট ড্রিংকস) পান করা। অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকা ধূমপান করা ও তামাক (জর্দ্দা, গুল, খৈনী, সাদাপাতা) খাওয়া গর্ভকালীন বিভিন্ন সমস্যা যাদের বাবা-মা অথবা রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের বয়স ৪৫ বছরের বেশি তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাজেই ডায়াবেটিস সম্পর্কে তাদের অধিকতর সতর্ক থাকা দরকার। বয়স যদি ৪০-এর বেশি হয় এবং ওজন যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় কিংবা বংশে যদি কারো ডায়াবেটিস থাকে, তবে অবশ্যই বছরে একবার ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে গর্ভবতীরা নিশ্চিত করবেন তাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কিনা। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মো. ইব্রাহিমের অমর বাণী- ‘প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগী যদি তিনটি উ- উরবঃ, উৎঁম, উরংপরঢ়ষরহব অর্থাৎ পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ এবং রক্ত পরীক্ষা ও নিয়মিত ব্যায়াম এই তিনটি নীতিকে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন মেনে চলেন, তাহলে তারা অবশ্যই স্বাভাবিকের কাছাকাছি, সামাজিকভাবে উপযোগী, সৃজনশীল কাজে সক্ষম ও সম্মানজনক জীবন নির্বাহ করতে পারবেন।’ তামাক ও ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ধূমপান ও তামাক সেবন ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা এবং জটিলতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তরুণ বয়সে ধূমপান শুরু করে, তারা পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন কেউ যদি ধূমপান, তামাক সেবন করে, তবে তাদেরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ফলে তাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও পায়ের পচনশীল রোগ ‘গ্যাংগ্রিন’ হওয়ার সম্ভাবনা ৫ গুণ বেশি। তাছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপানের কারণে ‘মাড়ির রোগ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ’ এর জটিলতা বেশি হয় এবং অকালে দাঁত পড়ে যায়। যারা (বিশেষত মহিলারা) জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ব্যবহার করেন, তাদের মুখের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের ঘাঁ হতে পারে, যেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে। নিয়মিত জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ব্যবহারে ডায়াবেটিসের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে না, ফলে মুখের ভেতরের বিভিন্ন রোগ বিশেষত মাড়ির রোগ ও মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক গুণে বেড়ে যায়। অতএব ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধে তামাক, জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ও সেই সঙ্গে ধূমপান অবশ্যই বর্জন করা প্রয়োজন। ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একবার হলে তা কখনো সারে না। তবে এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ যোগ্য। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারলে একে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। এজন্য যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের ডায়াবেটিস নেই উভয়কেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে। আর একটি কথা, ৫০ শতাংশের বেশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য। আজ থেকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করুন। কেননা অঙ্গহানি, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা ও অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। সামান্য উদ্যোগই রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে। প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ।

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : দন্ত বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র কনসালট্যান্ট (অনারারি), বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App