×

জাতীয়

মায়ের শাড়ি জড়িয়ে চিরনিদ্রায় সিরাজুল আলম খান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৩, ১০:০৬ পিএম

মায়ের শাড়ি জড়িয়ে চিরনিদ্রায় সিরাজুল আলম খান

শোক-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খান। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী উপজেলার আলীপুরে নিজ বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন রাজনীতির এই ‘রহস্য পুরুষ’।

১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সিরাজুল আলম খান। তার বাবা খোরশেদ আলম খান, মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন। তিনি ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান।

গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। শেষ বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।

দেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের পরিচিতি ছিল ‘তাত্ত্বিক নেতা’ ও ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক প্রস্তুতি পর্ব থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পরেও শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তিনি। যিনি পরবর্তীকালে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন রাজনীতির একজন তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে।

পাকিস্তান বিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বহু ঘটনার নেপথ্য নায়কদের একজন হয়েও নিজে কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি তিনি। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না রেখেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির একজন নেপথ্য নিয়ন্ত্রক।

[caption id="attachment_438422" align="aligncenter" width="700"] শনিবার রাজধানীর পল্টনে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ‘রাজনীতির রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খানের নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। এতে বিভিন্ন দলের নেতারা অংশগ্রহণ করেন। ছবি: ভোরের কাগজ[/caption]

বায়তুল মোকাররমে অশ্রুসিক্ত বিদায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে সকাল ১০টায় সিরাজুল আলম খানের প্রথম নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজার আগে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এসময় অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এতে জাসদসহ বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপি নেতারাও অংশগ্রহণ করেন।

জানাজায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে সিরাজুল আলম খানের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। দেশের রাজনীতিতে ‘দাদাভাই’ খ্যাত সিরাজুল আলম খান রাষ্ট্রের কাছ থেকে যথাযথ প্রাপ্য সম্মান পাননি বলেও অভিযোগ করেন তারা।

[caption id="attachment_438417" align="aligncenter" width="700"] শনিবার রাজধানীর পল্টনে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সিরাজুল আলম খানের নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। এসময় গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। ছবিটি তুলেছেন ভোরের কাগজের ফটোসাংবাদিক সাহাদাৎ হোসেন[/caption]

ডাকসুর সাবেক ভিপি আসম আব্দুর রব আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশ নামে একটা দেশ হবে, ১৯৬২ সালে এটা যখন কেউ চিন্তা করেনি, তখন তিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নিউক্লিয়াস গঠন করেছেন। আজকে এভাবে নিভৃতে আমাদের থেকে বিদায় নেবেন এটা ভাবতে কান্না আসে। ব্যক্তিগত জীবনে উনার কোনো লোভ-লালসা ছিল না। সিরাজুল আলম খান ব্যক্তি-পরিবারের সম্পত্তি নয়, সিরাজুল আলম খান দলের সম্পত্তি নয়, সিরাজুল আলম খান ১৮ কোটির মানুষের সম্পত্তি।

[caption id="attachment_438419" align="aligncenter" width="700"] শনিবার রাজধানীর পল্টনে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সিরাজুল আলম খানের নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। এসময় তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবিটি তুলেছেন ভোরের কাগজের ফটোসাংবাদিক সাহাদাৎ হোসেন[/caption]

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে কেবল একজনকে বড় করতে গিয়ে অন্যদের অবদান অস্বীকার করছে সরকার। স্বাধীনতার পর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি সিরাজুল আলম খান, তার বিদায়ের ক্ষতি পূরণীয় নয়, রাষ্ট্র তাকে যথাযথ সম্মান দেখায়নি।

সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আইয়ুব-মোনায়েমের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ও সামরিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে লড়াই এখানে গড়ে উঠেছিল সেখানে তার ভূমিকা, সেটা জাতির ইতিহাসে চিরদিন অক্ষয় হয়ে থাকবে।। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ঐতিহাসিক। পরবর্তীকালে রাজনীতিতে মতপার্থক্য হয়েছে। কিন্তু সে কারণে তার ঐতিহাসিক অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমি মনে করি তার যে যোগ্য মর্যাদা সম্মান দেয়া উচিৎ ছিল জাতির পক্ষ থেকে বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার যে অবদান তা অস্বীকার করা যাবে না। সিরাজুল আলম খান না থাকলে এই স্বাধীনতা কীভাবে বিকশিত হত, কীভাবে আসত এটা নিয়ে অনেক গবেষণার ব্যাপার আছে। সিরাজুল আলম খানকে সম্মান জানালে রাষ্ট্র ছোট হত না, রাষ্ট্রের কোনো ক্ষয় হত না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, নিরপেক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুর পরেই ইতিহাসে সিরাজুল ইসলাম খানের স্থান। নানা কারণে তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। কিন্তু তার যৌবনে যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন- ছয় দফা আন্দোলনে শ্রমিকদের সংগঠিত করা; বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দেয়া। তারও আগে ৬২ সালে এই ভুখণ্ড স্বাধীন করার উদ্যোগ নেয়া ও সেই আন্দোলনে লেগে থাকা; তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা এসেছে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন,‘গত শতাব্দীর ষাট দশকের শুরু থেকে যারা স্বাধীনতার জমিন তৈরি করেছেন সিরাজুল আলম খান তার অন্যতম। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সিরাজুল আলম খান আজীবন দেশ ও মুক্তির জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। প্রথাগত রাজনীতিকদের থেকে আলাদা সিরাজুল আলম খান ছিলেন প্রচারবিমুখ ও অনেকটা নিভৃতচারী। মানুষের জন্য তার ছিল গভীর ভালবাসা।

দ্বিতীয় জানাজা ও দাফন নোয়াখালীতে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে বেগমগঞ্জের আলীপুরে মা-বাবার পাশে দাফন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খানের মরদেহ। গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বেগমগঞ্জ পাইলট স্কুল মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে অনেক সংগঠন ফুল দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানায়।

এর আগে তার মরদেহের সামনে বিউগলের করুণ সুর বাজিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এ সময় স্যালুট প্রদান করেন বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়াসির আরাফাত। পরে গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার কবরের পাশে সিরাজুল আলম খানকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। এসময় অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

এদিকে পৈতৃক ভিটায় যখন তার মরদেহ আনা হয় তখন সেখানে প্রিয় নেতার মরদেহ দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। দেশের ও জেলার বিভিন্ন এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী শেষ দেখা দেখতে ও বেদনার অশ্রুতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে জড়ো হন সেখানে। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মায়ের শাড়ি জড়িয়ে দাফন করা হয় তাকে।

সিরাজুল আলম খানকে শেষ শ্রদ্ধা জানান নোয়াখালী-৩ আসনের সাংসদ মামুনুর রশিদ কিরন, বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিমুল বিশ্বাস, বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতি আবদুস সালাম, জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব, কবি ফরহাদ মজহার, জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম হায়দার বিএসসি, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, কেন্দ্রীয় যুবদলের সহসাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আজিম সুমন, জেলা জাসদের আহ্বায়ক আমির হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক নূর রহমান চেয়ারম্যান, ইকবাল হোসেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধর সি জোন কমান্ডার মোহাম্মদ উল্যাহসহ আরো অনেকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App