×

স্বাস্থ্য

চিকিৎসায় রেফারেল পদ্ধতি চালুর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৩, ০৯:০৯ এএম

চিকিৎসায় রেফারেল পদ্ধতি চালুর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
গত কয়েক মাস ধরেই বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন বাঞ্ছারামপুরের বাসিন্দা ছোটন দে (৩৫)। চলতি মাসের শুরুতে হঠাৎ করে সেই ব্যথা বাড়ে। হার্টের সমস্যা থেকে এমনটা হতে পারে- এই আশঙ্কা থেকে চিকিৎসার জন্য ছোটনকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখানে ইসিজি, ইকো, এক্স-রে, ইটিটি পরীক্ষার পাশাপাশি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরিমাপ করে জানা যায়, তার হৃদরোগ নেই। গ্যাস্ট্রিকের কারণে তার বুকে ব্যথা হচ্ছে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীকে মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা নিতে বলেন। এই চিকিৎসাসেবা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেই পাওয়া সম্ভব ছিল বলে জানান চিকিৎসক। প্রায়ই পেটের পীড়ায় ভুগতেন চাঁদপুরের বাসিন্দা জোৎস্না বেগম (৫৫)। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসি থেকে বেশ কয়েকবার ওষুধ কিনে খেয়েছেন। কিছুটা উপশম হলেও পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছিলেন না। বড় ছেলে যুবায়ের হোসেন থাকেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায়। ৯ মে জোৎস্না বেগমকে ঢাকায় এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করান যুবায়ের। যুবায়ের বলেন, আসলে ভরসা পাইনি। তাই মাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছি। ডাক্তার বেশ কিছু পরীক্ষা দিয়েছেন। সেগুলো করানোও হয়েছে। এখনো পর্যন্ত রিপোর্ট বলছে মার দীর্ঘমেয়াদি আমাশয় হয়েছে। ছোটন দে ও জোৎস্না বেগমের মতো অসংখ্য রোগী প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের অনেকেরই এলাকার হাসপাতালেই চিকিৎসা সম্ভব ছিল বলে বলছেন চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি রোগীর রেফারেল ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এমনটি হতো না। রেফারেল সিস্টেম হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে একজন রোগী প্রথমে নিকটবর্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাবেন। সেই কেন্দ্রের চিকিৎসক রোগীকে দেখে যদি প্রয়োজন মনে করেন তাহলে আরো উন্নত হাসপাতালে পাঠাবেন। সেখানেও একই পদ্ধতি মেনে রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য উন্নত বা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হবে। আবার ফলো-আপের জন্য রোগীকে বড় হাসপাতালগুলো ছোট হাসপাতালে ফেরত পাঠাতে পারেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের প্রায় ১৮ হাজার সরকারি ও ১৬ হাজার বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে দেশের অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত করা যেত। রোগীর খরচ কমত, রোগী সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেত এবং বড় হাসপাতালে অতিরিক্ত ভিড়ও কমত। অথচ বছরের পর বছর ধরে সরকার রেফারেল সিস্টেম চালু করা তো দূরের কথা, এর জন্য কোনো প্রোটোকলও তৈরি করতে পারেনি। যার ফলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে বরাবরই রেফারেল সিস্টেম চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও এ পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হয়নি। কেন এ পদ্ধতি চালু করা যাচ্ছে না- এমন প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর জন্য যে সদিচ্ছা রয়েছে তা সরকারের মধ্যে নেই। এছাড়া দক্ষ জনবলসহ অনান্য আনুসাঙ্গিক যে বিষয়েও সংকট রয়েছে। এছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যেও এ পদ্ধতিটি চালুর বিষয়ে অনীহা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে রংপুর বিভাগের জন্য রেফারেল সিস্টেম চালুর ঘোষণা দেন। তবে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও সহায়ক স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায় প্রক্রিয়াটি শুরুর আগেই ব্যর্থ হয়। এরপর ২০১৬ ও ২০১৯ সালে রেফারেল সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নেয়া হলেও দুইবারই ব্যর্থ হয়েছে। বলা যায় আলোচনা পর্বেই থেমে যায় সেই উদ্যোগ। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব ভোরের কাগজকে বলেন, রেফারেল সিস্টেম চালুর বিষয়ে আমরা বারবারই বলে এসেছি। এটি না থাকায় যে রোগীর মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা, সে যাচ্ছে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে; গ্যাস্ট্রোলজির রোগী যাচ্ছে মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে। এতে রোগীর যেমন সময়, মানসিক ও শারীরিক কষ্ট, আর্থিক অপচয় ঘটছে; তেমনি হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারেও অপ্রয়োজনীয় ভিড় জমছে। প্রকৃত রোগীর স্বাস্থ্যসেবাও বিলম্বিত হচ্ছে। অপচয় হচ্ছে চিকিৎসকের মেধা ও সময়ের। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিম্নমানের সেবা ও জনগণের আস্থার সংকট রেফারেল সিস্টেমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. লিয়াকত আলী ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে দেশে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব সেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন টারশিয়ারি ও বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু রয়েছে। একটি সিস্টেম চালু করতে গেলে সদিচ্ছা যেমন লাগবে; তেমনি সিস্টেম তৈরিও করতে হবে। রেফারেল সিস্টেম কার্যকরি করতে হলে একটা অবকাঠামো লাগবে। বিষয়টিকে যদি তৃণমূল ও শহর কেন্দ্রিক- এই দুই ভাগে বলি তাহলে দেখবো, এই সিস্টেমটা তৃণমূলে কিছুটা হলেও রয়েছে। রোগী কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা হাসপাতাল হয়ে বিভাগীয় হাসপাতালে যেতে পারে। কিন্তু তা বাধ্যতামূলক নয় বলে সুফল মিলছে না। জনবল এবং আনুসঙ্গিক সুযোগ সুবিধার সংকটও রয়েছে। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যন্ত্রপাতি প্রায় সময়ই কাজ করে না। দেখা যায় যন্ত্রপাতি আছে কিন্তু জনবল নেই। আর শহরের কথা যদি বলি তাহলে দেখব এখানে আরো বেশি সমস্যা। এখানে রেফারেলের কোনো ব্যবস্থাই নেই। সামান্য হাঁচি কাশি হলেও মানুষ মেডিকেল কলেজ বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে চলে যায়। কারণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা শহরে নেই। শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হচ্ছে বিষ ফোঁড়া। এক অনুষ্ঠানে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জেলাভিত্তিক পরিচালনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে নিয়মিত ডাক্তার থাকা, টেকনোলজিস্ট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা রেফারেল সিস্টেম চালু করতে না পারব, ততদিন এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App