×

মুক্তচিন্তা

রাজনৈতিক পরিবেশ এবং প্রস্তাবিত বাজেট

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৩, ১২:৫৯ এএম

রাজনৈতিক পরিবেশ এবং প্রস্তাবিত বাজেট

ক’টা দিন আর বাকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা, মুভমেন্ট বেড়েছে। মিছিল মিটিং, সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা, মানববন্ধন সবই চলছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দলীয় শোডাউনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনের। বাংলাদেশজুড়ে এই তৎপরতা চলছে। চলছে, পাল্টাপাল্টি আক্রমণ, দোষারোপ ও প্রতিহিংসামূলক কথাবার্তার প্রতিযোগিতা। সোজা কথায়, নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রচারণায় দেশ ও জাতির কল্যাণ ও স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রæতির চেয়ে পরনিন্দা, প্রতিহিংসামূলক কথা বলা হয় বেশি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে তথা আয়োজনে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো বোঝাতে চাইছে, কী ধরনের নির্বাচন তারা প্রত্যাশা করছে এবং সেই ধরনের নির্বাচন হলে তারাই জিতে যাবে, সেই আওয়াজও তাদের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে। যেমন, বিএনপি। নিজ বিজয়ের ঘোষণা প্রায় তারা দিয়ে বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে তারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বাস্তবায়নের কঠোর দাবি তাই বিএনপির। তারা এই দাবিতে অনড়। বিএনপি মনে করছে, বর্তমান সরকার ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র পচিালনায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ¦ালানি সংকট, লোডশেডিং, অর্থ পাচার ইত্যাদি কারণগুলোকে বিএনপি সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করছে। রাজনৈতিক তৎপরতাকে তারা দিনে দিনে আরো বেগবান করছে। ঘটনাপ্রবাহ অবলোকন করলে সেটাই পরিষ্কার হয়। বসে নেই ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার আওয়ামী লীগ। মাঠ আন্দোলনে তারাও সক্রিয় হয়েছে। শো-ডাউন চলছে। সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা, মিছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা তাদেরও। পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে তারাও ক্লান্ত নন। উন্নয়নের বিভিন্ন দিক তারা তুলে ধরছেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নির্বাচনে জনগণ আবারো তাদের ক্ষমতায় বসাবে। কারণ তারা দেশের উন্নয়ন করেছে, জনগণের জীবন-জীবিকাকে সহজতর করেছে। বাংলাদেশকে তারা ডিজিটাল করে স্মার্ট করতে এগোচ্ছে। আওয়ামী সরকার চাইছে না, বিএনপির দাবি মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বাস্তবায়ন করতে। তারা বলে দিয়েছে, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন কমিশন এবং রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। সদ্য সমাপ্ত গাজীপুরের মেয়র নির্বাচন তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সুতরাং নির্বাচন কমিশনই যথেষ্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠুভাবে একটা জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাস্তবায়নের জন্য। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সুখকর তেমন অভিজ্ঞতা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেই, সুতরাং বিএনপি গলা ফাটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করলে আওয়ামী সরকার সেইদিকে কর্ণপাত করে না, করছে না। উপরন্তু তারা বিএনপিকে ভীতু অর্থাৎ ভোটে অংশগ্রহণ করার সাহস নেই বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। রাজনৈতিক তৎপরতার কোনো ভালো উদাহরণ আমাদের দেশে একেবারে নেই বললেই চলে। যা আছে তা হলো, ভাঙ্গো, জ¦ালাও-পোড়াও, ধর্ষণ ও নিপীড়ন, মারাত্মক প্রতিহিংসার অজস্র ঘটনা এবং প্রবলভাবে দোষারোপের সংস্কৃতি। দুঃখ লাগে, দুঃখ পায় সাধারণ জনগণ। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াইয়ে আর্থসামাজিকভাবে কতটাই না তারা ঝুঁকিতে পড়ে, পড়ে যাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তার বালাই থাকে না। যাই হোক, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তুমুল প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব, ঠিক তখন আবির্ভূত হলো আমেরিকার ভিসানীতি। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতির উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তারই সূত্র ধরে বলা হয়েছে যে, যে বা যারা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেবে, সে বা তারা এবং তাদের আত্মীয়স্বজন আমেরিকায় যাওয়ার ভিসা পাবে না। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অন্য একটি দেশের নাক গলানোর ঘটনা বা গল্প তো রয়েছে। রাজনৈতিক ইস্যুতে বিএনপির বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার প্রবণতা তো রয়েছেই। আওয়ামী লীগ সেই অভিযোগ প্রায়ই করে। জনগণ মনে করে, বাইরের শক্তির সমর্থনের চেয়ে দেশের জনগণের সমর্থন জরুরি এবং শক্তিশালী। কারণ যে ভোট নিরপেক্ষ করার জন্য বিএনপির জোরালো আন্দোলন, সেই নির্বাচন তো আর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হবে না, হবে বাংলাদেশে। ব্যালট বাক্স বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্রেই থাকবে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুপ্রবেশের যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারিতা, তা বাংলাদেশের জন্য সুখবর বয়ে আনবে না। বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকট তৈরি করতে পারে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে। বিষয়টি গুরুতরভাবে সব রাজনৈতিক দলকে ভাবতে হবে। যাই হোক, প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিতিশীল এক অবস্থার মাঝেই নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদে বাজেট প্রস্তাব করা হলো। সবসময়ই বাজেট নিয়ে কিছু কথা থাকে। আলোচনা, সমালোচনা হয়। সংশোধনের দাবি ওঠে। যেটাই হোক, বাজেট নিজের মতো করেই শেষ পর্যন্ত চলে এবং একটা সময়ে সংসদে পাস হয়। প্রতিটি বাজেটেই কিছু না কিছু অসম্পূর্ণতা থাকে, থাকে ত্রæটি-বিচ্যুতি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান সময়ে দেশে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের স্বাভাবিকতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত ও বিপন্ন করেছে। এই শ্রেণির মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকছে বা থাকবে, সেই বিষয়ে গভীরভাবে কোনো ভাবনা ও পরিকল্পনা কাজ করেছে বলে মনে হয়নি। করোনার মতো অতিমারি ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর বৈশ্বিক যে সংকট, তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়লেও সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও সমন্বয়হীনতা ক্রমশ মানুষকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাজার ব্যবস্থাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও জরিমানা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার সরকারের চেষ্টাকে অনেকেই লোক দেখানো মনে করেছে। কেননা, ওতে বাজার ব্যবস্থাপনা জনবান্ধব হয়নি। সম্ভবত কিছুদিন আগে স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই কথায় প্রতীয়মান হয় যে, ব্যবসায়ীদের হাতেই দেশ। ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাধর এবং শক্তিশালী। তারা নিয়ন্ত্রণ করছে গোটা দেশ। তাদের ইচ্ছেতেই যেন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। অনেকে মনে করে, সরকার সবসময় ব্যবসায়ীদের গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। গুরুত্বের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল ও থেকেছে যে, ব্যবসায়ীরা এখন সরকারের মাথায় চড়ে বসেছে। পরিসংখ্যান করলে দেখা যাবে যে, রাজনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের অনেকেই আজ ব্যবসায়ী। কেমন বাজেট প্রস্তাব করা হলো? উদাহরণ দেয়া যায়, স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে যতই দুর্নীতি থাকুক না কেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কাজ করতেই হবে। আর কাজের পরিকল্পনা থাকলে তো বাজেট থাকা চাই। ঠিক আছে মানলাম, সরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভাবছে। কিন্তু কেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষা? বাজেটে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম বাড়ানো হলো। বাজেট প্রণেতারা কি জানেন, নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কতটা? বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিশোরী বয়স থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারীরা অসচেতনতা ও সামর্থ্যরে অভাবে পিরিয়ডের সময় অপরিচ্ছন্ন কাপড়, তুলা ব্যবহার করে। এতে তারা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। উপকূলবর্তী অঞ্চলে এর ভয়াবহতা বেশি। কিছু বেসরকারি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম বাস্তবায়িত হওয়ায় গ্রামগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদের মাঝে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার বাড়ছে। এমন কী প্রতিবন্ধী কিশোরীরাও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে শিখে গেছে। ঠিক এমন এক অবস্থায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা কী? এদিকে স্বাস্থ্যসেবাকে সমুন্নত রাখতে, প্রসারে বাজেট বাড়ানো হচ্ছে, অপরদিকে প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, মানেটা কী? এমন স্ববিরোধী আচরণ কেন বাজেটে? ২০২৩-২৪ সালের অর্থবছরের বাজেটে পাচারকৃত অর্থের ওপর কোনো প্রস্তাবনা নেই। গত অর্থবছরে ৭ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ আনার সুযোগ দেয়া হলেও অনেকে তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করে, এতে লোকসান দুভাবে, এক. আরেক দফায় সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। অর্থপাচারকারী হিসেবে তার নাম উঠবে। দুই. ৭ শতাংশ কর কম টাকা নয়। বরং লাভ হবে পাচারকৃত টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠালে। এতে মর্যাদা বাড়ার সঙ্গে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যাবে। দেখা যাচ্ছে, অসাধু, অন্যায়কারীদের সুযোগ-সুবিধা সবসময় থেকে যাচ্ছে। আবার আয়কর রিটার্ন দাখিল ছাড়াও ২ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা সাধারণ জনগণের পেটে আঘাত করার শামিল। ঘুরেফিরে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব বাড়ছে। এতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে বৈকি। এবারের বাজেট হওয়া উচিত ছিল, জনবান্ধব, নারীবান্ধব এবং প্রতিবন্ধীবান্ধব। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় করে দেয়ার চেষ্টাটা থাকা দরকার ছিল। বিদ্যুৎ, জ¦ালানি মূল্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কৌশল নির্ধারণ করা যেত দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে। যারা হয়তোবা একটা যৌক্তিক জনবান্ধব বাজেট পেশে সহায়তা করতে পারতেন। সবকিছুকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে না দেখে সর্বজনীন দৃষ্টিতে দেখা যেত। বিলাসবহুল জীবনযাপনের উপাদান, উপকরণের মূল্য বাড়িয়ে বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপাদানগুলোকে জনগণের কাছে সহনীয় মূল্যে পৌঁছে দেয়ার কৌশল খোঁজা অতি জরুরি ছিল। তেমন একটা বাজেট প্রস্তাবিত হলে জনগণের ভেতর আস্থা জাগত। কেউ কেউ মনে করছে, এমন বাজেটে ধনী, আরো ধনী হয়ে উঠবে। আগামীর জাতীয় নির্বাচনে এই বাজেট প্রভাব ফেলবে কিনা, এক ধরনের সংশয় জন্ম নিয়েছে। একজন বলছিল, সরকারের ভেতর এমন কেউ নেই তো, যে স্যাবোটাজ করছে? অসঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা, ভাবনা তো অনেক ধরনের সংশয়ের জন্ম দেয়। অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণ হয়।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App