×

জাতীয়

১০ ঘণ্টা পরও ঘরে ছিল তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২৩, ১০:৩৩ এএম

১০ ঘণ্টা পরও ঘরে ছিল তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নতুন ফ্ল্যাটে তেলাপোকা মারার ওষুধ থেকে বিষক্রিয়ায় দুই ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নেমেছে পুলিশের একাধিক ইউনিট। এই ওষুধ ব্যবহারকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেডের এক কর্মচারীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ভাটারা থানা পুলিশ। আরেকজনকে খোঁজা হচ্ছে। সেইসঙ্গে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট থেকে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে চাচ্ছে থানা পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এদিকে শোকে মুহ্যমান শায়েন মোবারত জাহিন (১৫) ও শাহিল মোবারত জায়ানের (৯) বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা। এমন মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারছেন না। শিশু দুটির মায়ের আর্তনাদ ও আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস। দুই ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে চলছে মা-বাবার বিলাপ।

এ প্রসঙ্গে গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রধান বলেছেন, এ ধরনের ট্যাবলেট খাদ্যগুদামে পোকামাকড় নিধনে ব্যবহার করা হয়। এক টন খাদ্যের বিপরীতে ৫৭টি ট্যাবলেট কাপড়ে বা টিস্যুতে মুড়িয়ে ব্যবহার করা হয়। এখন যে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, তাতে গুদামে ট্যাবলেট ব্যবহারের পর অন্তত তিন দিন পর্যন্ত মানুষ বা কোনো প্রাণীর প্রবেশ করা নিষেধ। ট্যাবলেটগুলো পরে ফেলে দেয়ার সময় নাক মুখ ও কান ঢেকে, চোখে গøাস পরে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, ট্যাবলেট থেকে বের হওয়া গ্যাস নাক, কান ও চোখের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। এটা অত্যন্ত বিষাক্ত বলে বাসায় ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ। যদি শিশুদের বাড়িতে ব্যবহার করা ট্যাবলেট অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড হয়ে থাকে, তবে তা ব্যবহার করা আইনবিরুদ্ধ হয়েছে।

ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম আসাদুজ্জামান বলেন, দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় পোকামাকড় নিধন প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের বিরুদ্ধে গত সোমবার বিকালে ভাটারা থানায় মামলা করেছেন তাদের বাবা। অবহেলাজনিত কারণ দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মী টিটু মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি পোকামাকড় নিধনে ওই বাড়িতে কাজ করা দুজনের একজন।

অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট ব্যবহারের কারণে শিশুদের বিষক্রিয়া হয়েছিল কিনা- এ প্রসঙ্গে ওসি বলেন, ছোট ছেলেকে ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন করা হয়েছে। বড় ছেলের ময়নাতদন্ত হয়েছে। সেই প্রতিবেদন হাতে আসার পর বোঝা যাবে কী কারণে বিষক্রিয়া হয়েছে। আদালত টিটুর দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন বলেও জানান তিনি।

নিহত শিশু দুটির বাবা মোবারক হোসেন কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে জানান, সন্তানরা তেলাপোকা ভয় পায়। নতুন ফ্ল্যাট হলেও তেলাপোকার উৎপাত ছিল অনেক। এজন্য শুক্রবার ওই প্রতিষ্ঠানকে ডেকেছিলেন। ঘরে তেলাপোকা নিধনের ওষুধ দেয়া হবে বলে স্ত্রী, দুই ছেলে ও মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা এসে ঘরের কোনায় কোনায় টিস্যুর মধ্যে একটি ট্যাবলেট দিয়েছিল। ওষুধ প্রয়োগ শেষে ওই কর্মীরা জানায়, তিন ঘণ্টা পরে ঘরে প্রবেশ করা যাবে। আর ১০ ঘণ্টা পর ট্যাবলেটগুলো ফেলে দিতে বলেছিলেন। পরে তিনি ঘর তালাবন্ধ করে পুরনো বাসা উত্তরায় বন্ধুদের আড্ডায় যান। আর তার স্ত্রী-সন্তানরাও উত্তরায় একটি দাওয়াতে যান। তারা একসঙ্গে গাড়িতে করে বাসায় ফেরেন ভোর ৪টায়। অর্থাৎ পোকামাকড় নিধনকর্মীরা চলে যাওয়ার প্রায় ১০ ঘণ্টা পর। ঘরে ঢুকেই তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ পেয়েছিলেন তারা।

মোবারক হোসেন আরো জানান, ঘরে ফেরার দু-তিন ঘণ্টা পর স্ত্রী ও তিন সন্তান বমি করে। তারা ভেবেছিলেন, এই গরমে দাওয়াতে ভারি খাবার খাওয়ার জন্য এমন হতে পারে। তখন ঘরের জানালাগুলো খুলে দেন। তেলাপোকা মারার জন্য যেসব জায়গায় ট্যাবলেটগুলো রাখা হয়েছিল, সেগুলো ফেলে দেন।

পরদিন শনিবার সারাদিন সবাই স্যালাইন, ফলের রসসহ তরল খাবার খান। রাতে তাদের স্বামী-স্ত্রীর কক্ষে দুই ছেলে বাবার সঙ্গে ঘুমায়। মা ছিলেন মেয়ের সঙ্গে আরেক কক্ষে। বড় ছেলে জাহিন রবিবার ভোরে তাদের ডেকে বলে, ছোট ভাই যেন কেমন করছে। পরে তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই মারা গেছেন জায়ান। এরপর জাহিনকে আইসিইউতে নেয়া হয়। ওইদিন রাত ১০টায় জানানো হয়, জাহিনও বেঁচে নেই… বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে যান মোবারক হোসেন।

এদিকে ক্ষণে ক্ষণে ছেলেদের নাম ধরে ডাকাডাকি করে বুকফাটা আর্তনাদ করছেন মা শারমিন জাহান। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, ছেলেরা তেলাপোকা খুব ভয় পেত। নতুন বাসা হলেও দুই ছেলের কক্ষেই তেলাপোকা ছিল। ওরা ভয়ে রাতে নিজেদের কক্ষে থাকতে চাইত না। এ কারণে তেলাপোকা মারতে পোকামাকড় নিধন প্রতিষ্ঠানকে ডেকেছিলাম। কেন তাদের ডাকলাম, তা নিয়ে আফসোস করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, তার ছেলেরা কত লক্ষ্মী, কত সুন্দর! ২৮ জুন জায়ান ১০ বছরে পা দেবে। ছেলে প্রতিদিন গুনত, কবে জন্মদিন আসবে!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App