×

জাতীয়

অবৈধ মধুমতি মডেল টাউন এখন ‘নান্দনিক হাউজিং’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২৩, ০৯:২২ এএম

অবৈধ মধুমতি মডেল টাউন এখন ‘নান্দনিক হাউজিং’

ফাইল ছবি

> সর্বোচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষিত > শত শত ভবন নির্মাণ ও প্লট বিক্রি চলছে > যে নামেই হোক তা অবৈধ : রাজউক > প্রকল্পের কোনো ভবিষ্যৎ নেই : বেলা

সাভারের বলিয়ারপুরে মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অবৈধ হলেও সেখানে কোনো কিছুই থেমে নেই। পিকনিক ও শ্যুটিং স্পট, সুইমিং পুল, রেস্টুরেন্ট, ডুপ্লেক্সে বাড়ি, অট্রালিকা, স্কুল- কী নেই সেখানে। নিষিদ্ধ এই প্রকল্পে গড়ে উঠেছে ঘনবসতি। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ একটি আবসিক এলাকায় যা যা থাকা দরকার, তার সবই রয়েছে সেখানে। আছে পল্লীবিদ্যুতের সুবিধা ও নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী। গড়ে উঠেছে গরু ও মুরগির খামার। ভেতরে না গেলে বোঝার উপায় নেই আসলে ওই প্রকল্প শুধু নামেই অবৈধ। বাস্তবে এর পুরোটাই অন্য ৮-১০টি হাউজিং প্রকল্পের মতোই চলছে। সর্বোচ্চ আদালতের চোখ ফাঁকি দিতে চার বছর আগে নাম বদল করা হয়েছে নান্দনিক হাউজিং। বাসিন্দাদের সুবিধার্থে গত বছর সেখানে কুরবানির পশুরহাট ইজারাও দেয়া হয়েছিল। নান্দনিক হাউজিং পরিচালনায় সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাজউক কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও নির্দেশে এর নাম বদল করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, এই প্রকল্পের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সব রিসোর্ট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হবে সময় মতো। তিনি বলেন, মামলায় মেট্রোমেকার্স এবং প্লট মালিকরাও বিবাদী। তাই নাম পাল্টে এই প্রকল্প রক্ষা করা যাবে না।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞা বলেছেন, মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্পটি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অবৈধ। এর নাম পাল্টে অন্য নাম করা হলে তাও অবৈধ। রাজউক এ ব্যাপারে অবশ্যই অভিযান চালাবে। রাজউক কর্মকর্তাদের পরামর্শ বা নির্দেশে নাম বদলের দাবিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেন তিনি।

সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফখরুল আলম সমর বলেছেন, মধুমতি মডেল টাউনের বড় অংশ তার ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত। কিছু অংশ আমিনবাজার ও ভাকুর্তা ইউনিয়নেও পড়েছে। সমর জানান, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অবৈধ হওয়ায় তার পরিষদ থেকে সেখানে কোনো বরাদ্দ নেই। তিনি বলেন, আইনি জটিলতা আড়াল করতে একটি চক্র মধুমতি মডেল টাউনের নাম বদলে নান্দনিক হাউজিং নাম দিয়ে ব্যবসা করে আসছে। তারা কারো অনুমোদন না নিয়ে সেখানে ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে চলেছে।

নান্দনিক হাউজিং সোসাইটির ম্যানেজার মাহমুদুর রহমান জানান, ২০১৯ সালে রাজউকের দুটি প্রতিনিধিদল মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প পরিদর্শনে আসেন। তারা পরামর্শ বা নির্দেশ দেন কোনোভাবেই মধুমতি মডেল টাউন নাম রাখা যাবে না। এরপর প্লট মালিকরা বসে নাম পরিবর্তন করে নান্দনিক হাউজিং করেন। এখন মেট্রোমেকার্স গ্রুপের সঙ্গে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, প্লট মালিকরা সমিতি করে বিদ্যুৎ, পানি ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান বলেন, এর সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা জড়িত। প্রকল্পের ভেতরে ছোটবড় ছয়টি রিসোর্ট রয়েছে। সাভারের বিলামালিয়া মৌজার এই জমিতে আছে বেশ কয়েকটি ডেইরি ফার্ম। নান্দনিক হাউজিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শাহনেওয়াজ খান সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে প্রশ্ন শুনে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি দুই মাসের ছুটিতে আছেন এমন দাবি করেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ কেউই আমলে নেয়নি। প্রকল্প অবৈধ ঘোষণা করা হলেও সেখানে যেন পাল্লা দিয়ে চলছে পাকা দালান নির্মাণ। কৌশলে চলছে প্লট হাতবদল। প্লট বিক্রির জন্য রীতিমতো মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। চার বছর আগে এর নাম বদল করে নান্দনিক হাউজিং করায় প্লট ও বাড়ির নামফলকে মধুমতি মডেল টাউন মুছে দেয়া হয়েছে কালি দিয়ে। অনেকে লাগিয়েছেন নতুন নামফলক। এলাকা বড় করতে পেছন ও পাশে সমানে চলছে পাশের ডোবা নালা ভরাটের কাজ। প্রকল্পের ভেতরে গড়ে উঠেছে জিঅন, লেকভিউ, অনভ্যালী, কল্লোল, ছায়াবীথি, রাজমহল নামে ছয়টি রিসোর্ট। আধুনিক ডিজাউনের অনেক বাড়িতে রাতভর চলে পার্টি, বসে মদ-নারী ও জুয়ার আসর। সে যেন এক ভিন্ন জগৎ। সেখানে গড়ে উঠা মিনি বারে একাধিকবার অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। তবুও থেমে নেই অসামাজিক কর্মকাণ্ড। নিয়মিত চলছে নাটক-সিনেমার শুটিং। বালু দিয়ে জমি ভরাট, ইট, বালু, রড সিমেন্ট সরবরাহ নিয়ে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। আছে প্লাস্টিকসামগ্রী তৈরির একটি কারখানাও।

প্রকল্পের ভেতর দিয়ে চলাফেরা করেন ভাকুর্তা ইউনিয়নের মুগড়াকান্দার বাসিন্দা বৃদ্ধ খলিলুর রহমান। তিনি জানালেন, এখানে কেউ কারো কথা শুনে না। নিজেরা ইচ্ছেমতো সব করে। শত শত পাকাবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। কৃষক হামিদ ব্যাপারী জানালেন, সব সাইনবোর্ড বদলে ফেলা হয়েছে। গ্রিলের দোকানের কর্মচারী রবিউল জানান, পিকনিক স্পটে সরকারি লোকজন নিয়মিত আসে। কিসের অবৈধ কারা অবৈধ করেছে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এখানে সবই আছে আধুনিক উপশহরের মতো। গরুর ফার্মের রাখাল রুহুল জানিয়েছেন, সেখানে ১০-১২টি ডেইরি ফার্ম রয়েছে। ফার্ম থেকেই প্রতি বছর গরু বিক্রি হয়। প্লট বা বাড়ির মালিকরা মূল ক্রেতা। এখানকার ঘরবাড়ি ভেঙে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয় মনে করে ভেতরের ফুড লাইব্রেরি রেস্টুুরেন্টের কর্মচারী সুমন মিয়া বলেছেন, স্থাপনা ভাঙতে কয়েক মাস নয় এক বছরেরও বেশি সময় লাগবে। তাও লাগাতার অভিযান চালালে।

প্রকল্পের ভেতরে ৫ ও ১০ কাঠা প্লট বিক্রির সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে প্লট মালিক আজিজুল ইসলাম বলেছেন, এ-১ এ নিচু জমি প্রতি কাঠা সাড়ে চার লাখ টাকা। আর বাউন্ডারি ঘেরা উঁচু জমি প্রতি কাঠা সাড়ে সাত লাখ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। মূলত প্লটের ভেতরের লোকজনই এসব বেচাকেনা করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে রেজিস্ট্রি বন্ধ থাকলেও প্রকল্পের ভেতরেই লোক রয়েছে। তারা কৌশলে ও গোপনে রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করে দেয়। গ্রেস ক্যাটল, আহনাফ এগ্রো এন্ড ফার্মস, জাহান এগ্রো এন্ড ডেইরি, জয়াতা এগ্রো, মুহাম্মদ ক্যাটল ফার্ম, বাকারাহ এগ্রো, সাদাফ এগ্রোর ফার্মের কর্মচারীরা জানিয়েছেন, সেখানে সরকারি-বেসরকারি অনেক বড় বড় কর্মকর্তার প্লট ও বাড়ি আছে। অন্য পেশার লোকদের মতো আছে অনেক সাংবাদিকদের প্লট, বাড়ি ও খামার।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ঢাকা সিটি মাস্টার প্ল্যানে এই জমিটি বন্যা প্রবাহ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০০৪ সালের আগস্টে এই প্রকল্পের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে বেলা। আবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটি পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, নগর উন্নয়ন আইন এবং রাজউকের বিধি লঙ্ঘন করে তৈরি করা হচ্ছে। হাইকোর্টে দায়ের করা আবেদনে বেলা উল্লেখ করে, প্রকল্পটি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এলাকার পরিবেশ নষ্ট এবং দূষিত হবে। ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই হাইকোর্ট এই প্রকল্পটিকে অননুমোদিত, অবৈধ এবং জনস্বার্থের বিরুদ্ধে বলে ঘোষণা করেন।

আদেশে আরো বলা হয়, এই প্রকল্পের প্লট ক্রেতাদের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে। ২০১২ সালের ৭ আগস্ট হাইকোর্টের এই রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্ট। মধুমতি মডেল টাউনকে অবৈধ ঘোষণা করে এই অঞ্চলটিকে একটি মুক্ত বন্যা প্রবাহ অঞ্চল হিসেবে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৩ সালের ১১ জুলাই আপিল বিভাগ ১৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে মেট্রো মেকারস এন্ড ডেভেলপারস লিমিটেডকে সাভারের বিলমালিয়া ও বালিরপুর মৌজার জলাভূমি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মেট্রো মেকারস এন্ড ডেভেলপারস লিমিটেড এবং প্রকল্পের প্লট মালিকরা রায়ের রিভিউ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে পাঁচটি পৃথক পিটিশন দায়ের করেন। ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ পাঁচটি রিভিউ পিটিশনই খারিজ করেন এবং আগের রায় বহাল রাখেন। ৫৫০ একর এলাকায় থাকা সব স্থাপনা ভেঙে ছয় মাসের মধ্যে জলাভূমিটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে মেট্রো মেকারস এন্ড ডেভেলপারস লিমিটেড কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। আদালত প্রকল্প মালিককে নির্দেশ দেন, সব প্লটের ক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন ফিসহ দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ ফেরত দেয়ার। এছাড়াও, প্রকল্পের মালিক ছয় মাসের মধ্যে এই জায়গাটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে রাজউককে তা করতে নির্দেশ দেন। অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং সেখানে নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে, গড়ে উঠেছে বসতি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App