×

জাতীয়

জামায়াতের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক দেশ জুড়ে বিস্তৃত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৩, ০৮:৩৪ এএম

জামায়াতের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক দেশ জুড়ে বিস্তৃত

জামায়াতে ইসলামী। ফাইল ছবি

গোপনে চলছিল সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবার প্রকাশ্যে মাঠে নামার হুংকার

দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর বাণিজ্য-জাল। সারাদেশে দলটির নেতাকর্মীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সেই সঙ্গে চলছে তাদের সাংগঠনিক কর্মকান্ডও। পুলিশী তৎপরতায় তারা আগের মতো প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে না পারায় গোপনে সরব রয়েছে। অনলাইনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে পুরোদমে। প্রতিদিনই তারা কোনো না কোনো ইউনিটের সভা-সমাবেশ করছে। কোনো নেতা-কর্মীর বাসায় বা ভার্চুয়ালি এসব করছে তারা। কৌশল পাল্টে জামায়াতের নেতাকর্মীরা মিশে গেছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। জামায়াত নেতারা মনে করেন, সাংগঠনিকভাবে জামায়াত দুর্বল হয়নি। বরং গোপনে গোপনে তারা বেশ সংগঠিত। সরকার বা আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থান জানান দেয়ার সুযোগ খুঁজছেন তারা। এজন্য বিএনপির প্রতি তেমন নির্ভরশীল না হলেও তারা মাঠ গরম করতে পারলে রাস্তায় নেমে পড়বে জামায়াতও। প্রকাশ্য রাজনীতি তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ায় মনযোগ বাড়িছে ব্যবসায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল-কলেজ-কোচিং সেন্টার), ডেভলপার, হাউজিং, হাসপাতাল, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবসহ নানান ব্যবসায় দারুণভাবে এগিয়েছে তারা। কৌশল হিসেবে অনেক এলাকায় আওয়ামী ঘরানার লোকজনকে তারা ব্যবসার অংশীদার করেছেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ইসলামী আন্দোলনের পথচলা কখনো নির্বিঘœ ছিল না; এখনো নয়। তাই বাধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেই দ্বীন বিজয়ী করার জন্য সবাইকে ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বর্তমান সরকারকে হঠাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক এসিসট্যান্ট সেক্রেটারী এডভোকেট সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে চার আইনজীবি গত সোমবার বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের অফিসে গিয়েছিলেন। তিনি ভোরের কাগজকে বলেছেন, জামায়াতের কোনো পদে না থাকলেও তিনি তাদের লিগ্যাল সাইট দেখেন।

জানা গেছে, প্রতিটি জেলা, উপজেলা, পৌরসভা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে জামায়াতের সাংগঠনিক কর্মী রয়েছে। সক্রিয় নারী উইংও। আছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎপরতা। এর মধ্যে অস্বচ্ছলদের বায়তুল মাল থেকে নিয়মিত সহায়তা দেয়া হচ্ছে। বায়তুল মালে দেশ-বিদেশ থেকে টাকা জমা হচ্ছে। এখনো সংগঠনে চেইন অফ কমান্ড সচল আছে। যুদ্ধাপরাধের মামলায় শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, কেন্দ্রীয় আমির ড. শফিকুর রহমান কারাবন্দি থাকলেও সাংগঠনিকভাবে তারা মনোবল হারায়নি। আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে তারা জোরালো ভূমিকা রাখার কৌশল নিয়েছে। জামায়াত মনে করছে, তাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকজন আগামি সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই বিপুল সংখ্যক প্রিসাইডিং ও সহকারি প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবে। এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন বিবেচনা করে তারা ভোট কেন্দ্রে কঠোর হবে। এতে নৌকার প্রার্থীরা নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারবে না। সেই সুযোগ নিবে বিএনপিসহ সরকার বিরোধীরা। ঢাকাসহ সবকটি মহানগরীতে জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে বেশ। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রতিবাদে আগাামি ৫ জুন তারা সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচীর ডাক দিয়েছে। মিছিল-সমাবেশ করতে এবারই তারা প্রথমবারের মতো পুলিশের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। পুলিশ অনুমতি দিলে তারা বড় জমায়েত করতে চায়।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করলেও দেশে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেনি সরকার। সেই অজুহাতে তারা প্রকাশ্যে মিছিল-সমাবেশ করতে চায়। এজন্য অজুহাত ও সুযোগ খুঁজছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোটে জামায়াত না থাকলেও আলাদাভাবে তারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ ২১ জন চিকিৎসককে আটক করে। তাদের অপারেশন ডিউটি থাকায় মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেয়া হয়েছে- যারা রাজশাহী ও রংপুর মেডিকেলের ছাত্র ছিলেন। নামকরা এসব চিকিৎসক জামায়াতের অর্থের যোগানদাতা হিসেবে পুলিশের কাছে তথ্য প্রমান রয়েছে। এই ২১ জনের যৌথ ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসা রয়েছে- যার লভ্যাংশের টাকা জামায়াতের তহবিলে যায়। ঢাকার পাশে সাভার ও ধামরাই এলাকায় একাধিক হাউজিং এবং ডেভলপার ব্যবসায় জামায়াতের নেতারা সরাসরি জড়িত। এদের বড় অংশ এক সময়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। খোলশ পাল্টে এরা ব্যবসায়ী পরিচয়ে ভাল অবস্থানে আছেন। এই এলাকার ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ বিনিয়োগ তাদের। নির্বিঘেœ চলা এসব প্রতিষ্ঠান বেশ বড় পরিসরে বিস্তৃত হয়েছে। যেখানে অনেক আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের সদস্যরাও চাকরি করছেন। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে এদের ব্যাপারে খবর রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকে আগামি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রিসাইডিং ও সহকারি প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। আবার অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানেও জামায়াতের লোকজন চাকরিতে বহাল আছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরে তাদের বিরাট নেটওয়ার্ক রয়েছে। আগে দাঁড়ি-টুপিওয়ালাদের ‘জামায়াত’ বলে ধারণা বা সন্দেহ করা হলেও তারা এখন আর সেই অবস্থানে নেই। সবার চোখে ধোকা দিতে তারা এখন অনেক আধুনিক হয়েছে। পাড়া-মহল্লায় মিশে আছেন সবার সঙ্গে। অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কার্যালয়ে তাদের কৌশলী যাতায়াত রয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র দাবি করেছে, আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা করে দলের ফান্ডে অনুদান দিতে পারবে এমন ব্যক্তিদের তালিকা করেছে জামায়াত। এজন্য তারা নিয়মিত বৈঠক করছে। এর মধ্যে বাড্ডায় এমন একটি বৈঠক থেকে ডিবি গুলশান বিভাগ বেশ কয়েকজনকে আটক করে এর সত্যতা পায়। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে তথ্য রয়েছে, একযুগে জামায়াতের সাথী বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সংগঠনের আমির ড. শফিকুর রহমান গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইল ফোন সূত্রে পুলিশ অনেক চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে বলে জানা গেছে।

জামায়াতের ঘনিষ্ট সূত্রের দাবি, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলায় তাদের শক্তি বেশি। আগামি নির্বাচনে তারা ১০০ আসনে শক্তভাবে লড়বে। দাড়িপাল্লা প্রতিক ফিরে পেতে ভোটের আগে অবস্থা বুঝে ফের আইনি লড়াই চালাতে চায় জামায়াত। এখন পাকিস্তানের সঙ্গে আগের মতো যোগাযোগ না থাকলেও বাংলাদেশে তারা নিজেরাই আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল। বন্যা, ঘূঁর্নিঝড়সহ যেকোনো দুর্যোগে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। সর্বশেষ বঙ্গবাজারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তারা ১৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। ফান্ডে টাকা থাকার কারণেই দুর্যোগে তারা সাথীদের পাশে দাঁড়াতে পারছে।

পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। সারাদেশে কোথাও তাদের কার্যালয় খোলা নেই। সব থানায়ই দলটির সদস্যরা নাশকতার মামলার আসামি রয়েছে। এদের মধ্যে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের পরিবারের কোনো আইনজীবী নিয়োগ দিতে হয়নি, ব্যয় হয়নি টাকা। জামায়াতের পক্ষ থেকে আইনজীবি নিয়োগ দিয়ে তাদের জামিন করানো হয়েছে। কারাগারে থাকা অবস্থায়ও তদারকি করা হয়েছে। যারা আটক হয়নি তাদের উচ্চ ও নিম্ন দুই আদালতেই জামিন করানো হয়েছে সাংগঠনিক দায়িত্বে। কারাবন্দিদের পরিবারেও দিয়ে আসছে আর্থিক যোগান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App