×

মুক্তচিন্তা

বিদ্যমান বাস্তবতায় সাহসী বাজেটের বিকল্প নেই

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৩, ০৪:০৪ এএম

বহুমুখী সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রা ঘোষিত হয়েছে এবারের বাজেটের মাধ্যমে। অনেকে বাজেটকে উচ্চাভিলাষী মনে করলেও আমার তা মনে হয় না। একে বরং আশাবাদী আর সংস্কারমুখী বাজেট হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। এটা মানতেই হবে যে বাজেটের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের পথে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় এমন সাহসী পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর কোনো বিকল্প ছিল না বলেই অনুভব করি। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাড়ে ৭ লাখ কোটিরও বেশি। আগের বছরের চেয়ে বাজেট বেড়েছে ১৫.৩৩ শতাংশ। আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে আরো বেশি (১৫.৪৭ শতাংশ)। রাজস্ব আদায়ে যে ‘কোয়ান্টাম জাম্প’-এর লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে তা অর্জন করতে বৈপ্লবিক সংস্কার দরকার হবে। ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করা যাবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করাই যায়। তবে এখন প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্কের সময় নয়। বরং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই নীতি মনোযোগ বেশি করে দরকার। চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তাই আসছে বছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার টার্গেটটি চ্যালেঞ্জিং মনে হচ্ছে। তবে এই লক্ষ্যমাত্রাকে অবাস্তব বলা যাবে না। কেননা বিশ্ববাজারে তো পণ্যমূল্য স্থিতিশীল হয়ে আসছে। বাজেট ঘাটতি প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.১৫ শতাংশ। এই অনুপাতকে সহনীয়ই বলা যায়। এই ঘাটতির ৫১ শতাংশ আসবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। তাই ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহে চাপ পড়বে। ব্যক্তি খাতের জন্য ঋণপ্রবাহ যতটা থাকবে তার বেশি অংশই যেন উৎপাদন ও কর্মসংস্থানমুখী উদ্যোগে যায় তা নিশ্চিত করা চাই। এ জন্য বাজেট ও মুদ্রানীতির সুসমন্বয় নিশ্চিত করতেই হবে। চলতি অর্থবছরে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব থাকলেও সংশোধিত বরাদ্দে তা ৩৭ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। আসন্ন অর্থবছরে চলতি বছরের সংশোধিত বরাদ্দের চেয়েও আরো ৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। ভর্তুকিতে কাটছাঁটের চাপ থাকার পরও জনজীবনে স্বস্তি আনতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বৃদ্ধি জনস্বার্থের প্রতি সংবেদনশীলতার প্রতিফলন। প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু কর প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে বলে মনে হয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় ধনীদের সম্পদের ওপর করের সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে ৪ কোটিতে উন্নীত না করলেও চলত। বিদেশ যাত্রায় বাড়তি করারোপ বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে সহায়ক হতে পারে। তবে বিদেশগামী শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের এর আওতার বাইরে রাখা উচিত। এছাড়া সিমেন্ট ক্লিঙ্কারের ওপর সুনির্দিষ্ট শুল্ক ২০০ টাকা বাড়ানোতে নির্মাণ খাত চাপে পড়তে পারে। স্মার্টফোনের দাম বাড়ানোও সমীচীন নয়। সার্বিক বিচারে কর প্রস্তাবগুলোকে বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল মনে হয়েছে। করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩.৫ লাখ করায় মুদ্রাস্ফীতির চাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পাবেন অনেক নাগরিক। করযোগ্য নন এমন ব্যক্তিদের জন্যও ন্যূনতম ২ হাজার টাকার করের প্রস্তাবটি অভিনব। বাড়তি রাজস্ব আয় এবং কর প্রদানের সংস্কৃতির প্রসারে এই সিদ্ধান্ত সহায়ক হতেও পারে। একাধিক গাড়ির মালিকদের জন্য বাড়তি কর, টেক্সটাইল বর্জ্য ব্যবসার ভ্যাট উঠিয়ে দেয়া এবং সৌরশক্তিচালিত পানিশোধন প্লান্টে অগ্রিম কর প্রত্যাহারের মতো সিদ্ধান্তগুলো পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকে বেগবান করবে। বিভিন্ন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াত দেয়ার ফলে আউট অব পকেট স্বাস্থ্য ব্যয় কিছুটা কমতে পারে। অনেক কর প্রস্তাব দেশীয় শিল্পের বিকাশে বিশেষ সহায়ক হবে বলে মনে হচ্ছে। যেমন- কাচ শিল্প ও সুইচ/সকেট প্রস্তুতকারকদের দেয়া করছাড় দেশীয় উৎপাদকদের সুবিধা দেবে। আবার আমদানিকৃত লো-ক্যাপাসিটি বৈদ্যুতিক প্যানেলের ওপর কাস্টম ডিউটি ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করায় যারা দেশে এসব প্যানেল তৈরি করেন তারা সুফল পাবেন। কম্পিউটার ও আইসিটি পণ্যে ভ্যাট ছাড় জুন ২০২৬ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত কিছু গার্হস্থ্য ইলেক্ট্রনিক পণ্যেও এমন ছাড় দেয়া হয়েছে। এগুলো সময়োচিত প্রস্তাবনা। হাতে বানানো বিস্কুট ও কেকের ক্ষেত্রে ভ্যাটমুক্ত সীমা বাড়ানোর ফলে সুবিধা পাবেন ছোট কলেবরের উদ্যোক্তারা। অর্থনৈতিক অস্থিরতার এ সময়ে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বিশেষ মনোযোগের দাবিদার। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ চলতি বছরের সংশোধিত করার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি করা হয়েছে। নগদ সহায়তা পাবেন প্রায় ১ কোটি ৩৯ লাখ ব্যক্তি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ (৫৮ লাখ) পাবেন বয়স্ক ভাতা। বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের জন্য কর্মসূচির জনপ্রতি ভাতা ও উপকারভোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দ নিয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন নগদ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশই চলে যাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনে। এই পেনশন বাদ দিলে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার অংশ ১৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ। এবারের বাজেট প্রস্তাবে নতুন কোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেয়া হয়নি। বিদ্যমান বাস্তবতায় নগরাঞ্চলের কম আয়ের পরিবারগুলোর জন্য পাইলট ভিত্তিতে হলেও নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। সংকটকালে বাজেট বরাদ্দে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতগুলোতে কাটছাঁটের প্রভাব বেশি পড়ে। প্রস্তাবিত বাজেটে এমন কাটছাঁট নজরে না এলেও মনে হচ্ছে গতানুগতিকতার বাইরে যাওয়ার চেষ্টাও করা হয়নি। মোট বাজেট ১৫ শতাংশের বেশি বাড়ানো হলেও শিক্ষা বাজেট আগের বছরের চেয়ে মাত্র ৮.২৪ শতাংশ বেড়েছে। শিক্ষা বাজেট ৮৮ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট বাজেটের ১১.৫৭ শতাংশ (চলতি বছরে ১২ শতাংশের বেশি ছিল)। জিডিপির শতাংশ হিসেবেও শিক্ষা বাজেট ছোট হয়ে এসেছে। চলতি বছরে ১.৮৩ শতাংশ থেকে কমে আসন্ন বছরে ১.৭৬ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জিডিপির শতাংশ হিসাবে শিক্ষায় বরাদ্দের বিচারে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তুলনায় পিছিয়ে আছি (দক্ষিণ এশিয়ার গড় ২.৮৫ শতাংশ, আমাদের গড় ১.৯৭ শতাংশ)। প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য বাজেট ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট বাজেটের ৫ শতাংশ। এক দশক ধরেই এই অনুপাত অপরিবর্তিত আছে। বরাদ্দের গতানুগতিকতার কারণে আউট অব পকেট স্বাস্থ্য ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে আমাদের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের মাত্র ২৩ শতাংশ আসে সরকারের বরাদ্দ থেকে আর ৬৮ শতাংশই বহন করতে হয় নাগরিকদের। তাই বাজেটে স্বাস্থ্যের অংশ বাড়ানো গেলে নাগরিকদের ওপর চাপ কিছুটা কমত। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়নের অদক্ষতার কারণেই হয়তো স্বাস্থ্যের অংশটি বাড়ানো যাচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২১-২২-এর মোট বরাদ্দের ২৪ শতাংশই বাস্তবায়ন করা যায়নি। একদিকে ছিল ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে সৃষ্ট সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে সংকোচনমুখী বাজেট তৈরির চাপ, অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জনতুষ্টিবাদী কর্মসূচি ও উদ্যোগে বরাদ্দ দেয়ার তাগিদও ছিল। প্রাথমিকভাবে বাজেট ডকুমেন্টগুলো পর্যালোচনা করে মনে হচ্ছে নির্বাচনমুখী জনতুষ্টিবাদ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই এ বাজেটের মূল লক্ষ্য। ড. আতিউর রহমান : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App