×

জাতীয়

দাবদাহে লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৩, ০৮:০১ এএম

দাবদাহে লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ

ফাইল ছবি

আমদানিনির্ভরতা এবং জ্বালানি খাতে গুরুত্ব কম দেয়ায় বিদ্যুৎ খাতে বিপর্যয়

জ্বালানি সংকটের কারণে একের পর এক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর সর্বশেষ সংযোজন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ডলার সংকটে এলসি খুলতে দেরি হওয়ায় জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপক হারে কমেছে। এদিকে দেশজুড়ে বয়ে যাচ্ছে দাবদাহ। বিদ্যুৎ সংকটে বেড়ে গেছে লোডশেডিং। চরম ভোগান্তিতে পড়েছে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সঠিক নীতির অভাবেই জ্বালানির সংকট দেখা দিয়েছে এবং বিদ্যুৎ খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বৈশ্বিক জ¦ালানি সংকট শুরু হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হলেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। বিদ্যুৎ খাতকে ‘বাণিজ্যিক’ বিবেচনায় না নিয়ে ‘সেবা খাত’ হিসাবে মূল্যায়ন করতে হবে। এই খাতের উন্নয়ন করতে গিয়ে কোথায় ভুল হয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এখন ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছিল ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। ২ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ ঘাটতির আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু এই চাহিদা মেটাতেই বিদ্যুৎ বিভাগ এখন হিমশিম খাচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ডলার সংকটের কারণে সময়মতো কয়লা, গ্যাস ও ডিজেল আমদানিতে ভাটা পড়ে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪৭ শতাংশই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু পেট্রোবাংলা বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদার বিপরীতে অর্ধেক জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে। এছাড়া পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা রয়েছে। এসব কারণে দেশের প্রায় ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আগামী সোমবার থেকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটটিও বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দুই ইউনিটবিশিষ্ট ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি ইউনিট গত ২৫ মে বন্ধ হয়ে যায়। ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার অপর ইউনিটও বন্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। শুধু কয়লা সংকটের কারণে এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি বন্ধ হয়েছে। তবে খুব শিগগির বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। গ্যাস ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বাড়িয়ে ঘাটতি মোকাবিলা এবং পরিস্থিতি সহনীয় করার চেষ্টা চলছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, গ্যাস থেকে ৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েল থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট, কয়লা থেকে ৩ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য উৎস থেকে ১ হাজার মেগাওয়াটসহ মোট ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কয়লা থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। গ্যাস থেকে উৎপাদন কম হলেও এর ওপরই এখন ভরসা রাখতে হচ্ছে। চলতি মাসের শেষের দিকে সংকট অনেকটাই কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সারাদেশে লোডশেডিং বেড়েছে। প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং চলছে। জ্বালানি সংকটের কারণে ৫ জুনের পর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িক সময়ের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ডলার সংকটের কারণে সময়মতো এলসি খোলা সম্ভব হয়নি। এখন এলসি খোলা হয়েছে। তবে কয়লা আমদানি করতে আরো অন্তত ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগবে। তবে জুন মাসের শেষের দিকে পায়রা ও রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আবার পূর্ণ উৎপাদনে এলে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়বে এবং লোডশেডিং কমবে।

বিদ্যুৎ খাতে নাজুক পরিস্থিতির জন্য নীতিনির্ধারকদের ভুল নীতিকে দায়ী করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য পরিকল্পিতভাবে যেসব উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ছিল তা নেয়া হয়নি। সমাধানের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তাতে গলদ আছে। এখন সবকিছু রিভিউ করার সময় এসেছে। বিদ্যুৎ খাতকে ‘বাণিজ্যিক’ বিবেচনায় না নিয়ে ‘সেবা খাত’ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। এই খাতের উন্নয়ন করতে গিয়ে কোথায় ভুল হয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ালেই দামের ক্ষেত্রে টানাপড়েন বাড়বে, আমরা ভূ-রাজনীতির শিকার হব- এসব চিন্তা না করে রপ্তানিনির্ভর হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের রক্ষণশীল হওয়ার প্রয়োজন ছিল।

অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, আমাদের মতো দরিদ্র, স্বল্প আয়ের দেশে সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি অপচয় ও অপব্যয়ের পরিচয় দিয়েছি। সাধ্য ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে কাজ করিনি। বাজেটে জ্বালানি খাতের উন্নয়নে টাকা থাকে না। সিংহভাগ টাকা বিদ্যুৎ খাতে দিয়ে উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যয় হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সম্পদ সংগ্রহের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে না। এতে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এই খাতকে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে, আইন তৈরি করে, প্রতিযোগিতাহীন করে এই খাতের ব্যয় চরমভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে আমরা বিদেশিদের কাছ জিম্মি হয়ে গেছি। বিদেশিরা রপ্তানির সুযোগ চায়। তাদের অব্যাহতভাবে রপ্তানির সুযোগ দেয়া হলে আমাদের নাইজেরিয়া বানিয়ে ফেলবে- সেটা আমরা কখনো ভাবিনি, আমাদের সক্ষমতাও তৈরি হয়নি।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে, মানুষের কষ্ট কমাতে নানান পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্যসব দেশের মতো আমরাও বৈশ্বিক সমস্যার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারিনি। ডলার সংকট অন্যতম কারণ। সংকট মেটাতে অর্থের সংস্থান করতে জ্বালানি বিভাগ, মন্ত্রণালয় ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। পায়রার কয়লার জন্য এলসি খোলা হয়েছে। সরকার অর্থের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছি।

এদিকে তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিং বাড়তে থাকায় সারাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র দাবদাহ ও লোডশেডিংয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নানান বয়সি অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান জানান, এক ঘণ্টা পর পর বিদ্যুৎ যাচ্ছে। তীব্র গরমের পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। শিশু ও বয়স্করা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানোর পড়ও লোডশেডিং মেনে নেয়া যায় না।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা হানিফ মোহাম্মদ বলেন, গরমের কারণে এমনিতেই ঘুমাতে দেরি হয়। ভোরের দিকে যখন ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে তখনই লোডশেডিং শুরু হয়। গরমে সবার ঘুম ভেঙে যায়।

পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন বলেন, তীব্র গরমে দোকানে বসে থাকা দায়। তারপরও পেটের দায়ে বসে থাকি। সারাদিন পরিশ্রমের পর রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় ঘুমাতে পারি না। গরম আর লোডশেডিংয়ে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App