×

সাহিত্য

জ্ঞানভিত্তিক প্রজন্ম গড়তে বইয়ে বরাদ্দ বাড়াতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৩, ০৯:১০ পিএম

https://www.youtube.com/watch?v=v1iyf0KM3q0

বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর বাস্তব অবস্থা, সক্ষমতা ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুদানে দেশের চারটি প্রশাসনিক বিভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের ৩৬টি জেলার নয়টি জোনে ১৪৪টি গ্রন্থাগারের পাঠক ও গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের ওপর জরিপ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ।

সোমবার (৫ জুন) দুপুরে রাজধানীর গুলিস্তানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের আয়োজনে ‘গবেষণা কার্যক্রমের প্রতিবেদন প্রকাশ ও সুপারিশসমূহ উপস্থাপন’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য মফিদুল হক। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি মিনার মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোস্তাক গাউসুল হক। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সিটি এডিটর কানাই চক্রবর্তী, রাইজিং বিডিডটকমের নির্বাহী সম্পাদক তাপস রায়, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র রিপোর্টার পাভেল রহমানসহ বিভিন্ন পাঠাগারের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা।

দেশব্যাপী বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর কার্যকারিতা ও সক্ষমতা যাচাইয়ের একটি বড় মাধ্যম গবেষণা এমন মন্তব্য করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মফিদুল হক বলেন, বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো সমাজে নানা প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে শুদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশ ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে ভূমিকা রেখে চলেছে এর স্বীকৃতি হচ্ছে- চার জেলায় পরিচালিত এই গবেষণা প্রতিবেদন। এই গবেষণার মধ্য দিয়ে বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। পাঠাগারের নানা দৈনতা, ঘাটতি এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যেও পর্যায়ক্রমে মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদে গবেষণার সুপারিশগুলোর আলোকে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে এর কার্যক্রম।

পাঠাগার পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য লাইব্রেরিয়ানদের (গ্রন্থাগারিক) প্রশিক্ষণের সুপারিশ করে মফিদুল হক আরো বলেন, পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করতে এই চ্যালেঞ্জ গ্রন্থকেন্দ্র নিতে পারে। পাশাপাশি, জনসম্পৃক্ততা বা পাঠক বৃদ্ধির লক্ষ্যে গতিশীল নেতৃত্বের ওপর জোর দিতে হবে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে মফিদুল হক বলেন, একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে গ্রন্থকেন্দ্রের পাঠাগার প্রকল্পের জন্য চার গুণ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলো- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০ কোটি টাকার বই কিনেছে। যে বই কিনেছে তা চিন্তাও করা যায় না যে এইসব বই কী করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তারা দিচ্ছে। এর পেছনে যারা জড়িত রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন। এটা দুঃখজনক।

শ্রেণিকক্ষের বাইরে অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষার ওপর জোর দেয়া যেতে পারে এমন মন্তব্যও করেন এই সমাজ চিন্তক।

নানা কারণে মানুষ বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে উল্লেখ করে মিনার মনসুর বলেন, যে বাংলাদেশে মেট্রোরেল, কর্নফুলী টানেল কিংবা পদ্মাসেতু হতে পারে সেই দেশে বইয়ের জন্য বরাদ্দ ২৫ কোটি টাকা হওয়া উচিত। অথচ বইয়ের জন্য মাত্র ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা! বই এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা বড়ই এতিম। একটি জ্ঞাননির্ভর প্রজন্ম গড়ে তুলতে বইয়ের জন্য বাজেট বাড়ানো ও বইয়ের দিকে সরকারের মনোযোগ দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আজকের দিনে কেবল বইয়ের দিকে নজর দিয়ে কোনো পাঠাগার চালানো যাবে না। পাঠককে বইয়ের কাছাকাছি আনতে হলে পাঠাগারগুলোকে ‘সাংস্কৃতিক হাব’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতির বিস্তার, তরুণদের বিপথগামিতা- সমাজে বিরাজমান নানাবিধ সমস্যার মধ্যে সম্ভাবনার দীপশিখা হয়ে জ্বলে আছে বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো এমন মন্তব্য করে ছয়টি সুপারিশ পেশ করেন কাজী মোস্তাক গাউসুল হক।

তিনি বলেন, নানা প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শুদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশ আর সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির নানা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তারা। দীর্ঘদিন ধরে এসব গ্রন্থাগারের কর্মকাণ্ড চলমান থাকলেও তাদের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমাজে তাদের প্রভাব পরিমাপের কোনো সমন্বিত উদ্যোগ এর আগে গৃহীত হয়নি। ফলে গ্রন্থাগারগুলোতে বিদ্যমান নানা সমস্যা যেমন সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়নি তেমনি কোন ধরনের কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করলে এদের কার্যক্রম গুণ ও মানগত উৎকর্ষ অর্জিত হবে সেটিও জানা যায়নি। সেদিক থেকে বর্তমান উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এ উদ্যোগ থেকে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি গ্রন্থাগারসমূহের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার একটি চিত্র পাওয়া গেছে।

বক্তারা শিক্ষা কার্যক্রমে গ্রন্থাগারের উপযোগিতা অন্তর্ভূক্ত করা, বইয়ের প্রতি মনোযোগে বিনিয়োগ বাড়ানো, বই পাঠের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠাগারের সঙ্গে স্থানীয় পাঠাগারকে সম্পৃক্ত করা, পাঠ্যসূচিতে বই পড়া বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান।

ছয় সুপারিশগুলো হলো প্রথমত, গ্রন্থাগারগুলোতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সময়ের দাবি। জরিপ এবং ফোকাস গ্রুপ আলোচনা- উভয় ক্ষেত্রেই এ দাবির প্রতিফলন ঘটেছে। একটি ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর ও স্ক্রিন- এই তিন উপকরণের সমন্বয়ে গ্রন্থাগারগুলো পাঠচক্রসহ তাদের অন্যান্য কর্মসূচিকে আরো কার্যকর করে তুলতে পারে। ভিডিও প্রদর্শনী, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি কর্মসূচিকে ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে এই উপকরণগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একটি প্রকল্পের আওতায় গ্রন্থাগারগুলোকে এ তিনটি উপকরণ সরবরাহ করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বর্তমানে অধিকাংশ গ্রন্থাগার নিজেদের খেয়ালখুশিমতো উপায়ে সামগ্রী সংগঠন করছে। সংগ্রহের আকার যখন বড় হবে তখন সামগ্রী সংগঠনে নানা সমস্যার সম্মুখীন হবে গ্রন্থাগারসমূহ। তাছাড়া অভিন্ন মান অনুসরণ না করায় ভবিষ্যতে আন্তঃগ্রন্থাগার সহযোগিতার মতো কার্যক্রম হাতে নিতে গেলেও সমস্যা দেখা দেবে। এ বিবেচনায় সকল গ্রন্থাগারে অভিন্ন, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে শ্রেণিকরণ ও সূচিকরণ করতে হবে।

তৃতীয়ত, বেসরকারি গ্রন্থাগারে পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গ্রন্থাগারকেন্দ্রিক কর্মসূচিকে জোরদার করতে হবে। এ ধরনের কর্মসূচির মধ্যে পাঠচক্র কার্যকারিতার বিচারে সবচেয়ে এগিয়ে। সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট বই বা লেখককে ঘিরে পাঠচক্র আয়োজিত হয়, যা বই ও গ্রন্থাগারের সঙ্গে পাঠকের সংযুক্তি বাড়ায়। অনুদানপ্রাপ্ত বেশকিছু গ্রন্থাগারে পাঠচক্র আয়োজিত হলেও বহু গ্রন্থাগারে হয় না, আবার হলেও তা নিয়মিত নয়। এ কারণে অনুদানপ্রাপ্ত সকল গ্রন্থাগারে একটি অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রম হিসেবে পাঠচক্র আয়োজন করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে একট বার্ষিক পাঠ কার্যক্রম প্রণয়ন করা যেতে পারে, যার আওতায় গ্রন্থাগারগুলো নির্দিষ্ট বিরতিতে নিয়মিতভাবে পাঠচক্র আয়োজন করবে।

চতুর্থত, জরিপের আওতাধীন গ্রন্থাগারগুলোর একটি বড় অংশ পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে ভুগছে। অনেক গ্রন্থাগারই স্থানীয় উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে কেবল সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। ফলে তাদের সংগ্রহ ও সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তহবিল-স্বল্পতা নিরসনের মাধ্যমে গ্রন্থাগারসমূহ যাতে সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে সেজন্য সরকারি অনুদানের হার ২৫ (পঁচিশ) শতাংশ বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হচ্ছে। স্থানীয় বিভিন্ন উৎস (সমাজসেবী, উন্নয়ন সংগঠন, দাতা, সদস্যদের চাঁদা) থেকে তহবিল সংগ্রহের কাজকে জোরদার করার জন্যও গ্রন্থাগারগুলোকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

পঞ্চমত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে স্থানীয় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ব্যবহারের পাশাপাশি স্থানীয় বেসরকারি গ্রন্থাগারেও নিয়মিত আসে ও গ্রন্থাগারের পাঠচক্র, কুইজ, চিত্রাঙ্কনসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সেজন্য অভিভাবক ও শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে লাইব্রেরি ক্লাসসহ গ্রন্থাগারকেন্দ্রিক নানা কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করে সেজন্য উৎসাহিত করতে হবে।

ষষ্ঠত, অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারসমূহের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য নিয়মিত মনিটরিং ও তত্ত্বাবধান অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বর্তমানে যে জনবল আছে তাতে অনুদানপ্রাপ্ত সকল গ্রন্থাগারকে নিরবচ্ছিন্নভাবে মনিটরিং করা সম্ভব নয়। এ বিবেচনায়, গ্রন্থাগারসমূহের সুষ্ঠু মনিটরিং ও তাদের কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের (ভধপরষরঃধঃরড়হ) উদ্দেশ্যে এসব গ্রন্থাগারকে একটি ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এসব গ্রন্থাগারের কার্যক্রম সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করতে সক্ষম হবে। গ্রন্থাগারগুলো যাতে নিয়মিতভাবে তাদের কার্যক্রম সম্বন্ধে প্রতিবেদন পেশ করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App