×

জাতীয়

ন্যূনতম কর নিয়ে বিতর্ক-বিভ্রান্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৩, ০৮:৫৩ এএম

ন্যূনতম কর নিয়ে বিতর্ক-বিভ্রান্তি

করযোগ্য আয় না থাকলেও টিআইএনধারীকে দিতে হবে ২ হাজার টাকা : নাখোশ অনেকে

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমার নিচে যাদের আয়, তাদের জন্যও ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এমন প্রস্তাবকে বিভিন্ন মহল বৈষম্যমূলক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তবে এ নিয়মে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে না বলে মনে করছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।

প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির ১০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র আছে। কিন্তু তার করযোগ্য কোনো আয় নেই। দুই বছর আগে ব্যাংকে টিআইএন দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন। চলতি অর্থবছরে টিআইএনের পরিবর্তে ব্যাংকে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হয়। স্লিপ না দিলে সঞ্চয়পত্রের সুদ আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটার বিধান রয়েছে। আর স্লিপ জমা দিলে ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়। বাড়তি উৎসে কর কাটার হাত থেকে বাঁচতে চলতি অর্থবছরে ওই ব্যক্তি শূন্য রিটার্ন জমা দিয়ে স্লিপ নিয়েছেন। কিন্তু আগামী অর্থবছরে শূন্য রিটার্ন জমা দিলেও স্লিপ পেতে তাকে দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।

বর্তমানে ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক। এগুলো হচ্ছে- ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিলে; কোম্পানি পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হলে; আমদানি-রপ্তানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি-ইআরসি) নিতে; সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে; সমবায় সমিতি নিবন্ধন নিতে; বিমা কোম্পানির সার্ভেয়ার হতে; ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি-ফ্ল্যাটের দলিল করতে; ক্রেডিট কার্ড নিতে; পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ নিতে; ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স ও ছাড়পত্র পেতে; গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে; ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সন্তান ভর্তি করতে; কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিতে; অস্ত্রের লাইসেন্স নিতে; ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে; ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে; নির্বাচনে অংশ নিতে; সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১৬ হাজার টাকা হলে; এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পেলে; পণ্য আমদানি-রপ্তানির বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক। আগামী বাজেটে এর সঙ্গে আরো আটটি সেবা যুক্ত হচ্ছে। আগে শুধু টিআইএন দিয়ে এসব সেবা নেয়া যেত। চলতি বাজেটে টিআইএনের পরিবর্তে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করে এনবিআর।

জাতীয় সংসদে পেশ করা বাজেট বক্তব্য অনুযায়ী, রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে এমন করদাতার মোট আয়করমুক্ত সীমা অতিক্রম না করলেও আয়ের পরিমাণ নির্বিশেষে ন্যূনতম করের পরিমাণ দুই হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। সেক্ষেত্রে প্রস্তাব অনুযায়ী, ৩৮ ধরনের সেবা নিতে হলে করদাতাকে দুই হাজার টাকা ন্যূনতম আয়কর দিয়ে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তার যদি আয়কর দেয়ার মতো আয় নাও থাকে, তারপরও তাকে দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। জানা গেছে, প্রস্তাবিত নতুন আয়কর আইনে এক্ষেত্রে আরো ৬টি সেবা যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে আরো ছয় ধরনের সেবা পাওয়ার জন্য দুই হাজার টাকার ন্যূনতম আয়কর রিটার্নের প্রমাণ দাখিল করতে হবে।

রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ আছেন- যাদের একটি কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন রয়েছে। নানা কারণে তারা এটি নিয়েছেন। এদের মধ্যে ৩০ লাখের কিছু বেশি মানুষ তাদের রিটার্ন জমা দেন। তাদের অনেকেই শূন্যকর দেখিয়ে রিটার্ন জমা দেন, অর্থাৎ আয়কর দেয়ার মতো আয় তাদের নেই। আগামী অর্থবছর থেকে বিপদে পড়তে যাচ্ছেন তারা। এরপর ঝামেলায় পড়বেন তারা, যাদের ৪৪টি সেবার কোনো একটি নেয়ার প্রয়োজন হবে।

বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার এক বাজেট পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করারোপের প্রস্তাবটি ‘বৈষম্যমূলক’। তিনি বলেন, কারো যদি আয় সাড়ে তিন লাখের নিচেও হয়, তাহলেও সরকারি ৩৮টি সেবা নিতে টিন লাগবে। করযোগ্য আয় না থাকলেও তাকে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে এখানে করমুক্ত আয় বাড়িয়ে আবার যার করযোগ্য আয় নেই তার ওপর দুই হাজার টাকার কর আরোপ করা- এটা কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয় তা আমরা খুঁজে পাই না।

তিনি আরো বলেন, যে কর দেয়ার যোগ্য, ক্ষমতা-আয় আছে সেই তো কর দেবে, কিন্তু যার নেই তার ওপর আবার বসিয়ে দিলাম। এটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। নৈতিকভাবেও এটা ঠিক নয়। এটা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে। ফলে মূল যে উদ্দেশ্য ছিল সেটিও নষ্ট হয়ে গেল। এ বিষয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যাদের করযোগ্য আয় নেই, তারাও এ করের আওতায় পড়বেন। এ কারণে উদ্যোগটি নৈতিকতার দিক থেকে ঠিক নয়, আবার যৌক্তিকও নয়।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এর ফলে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হবে। তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে যারা স্লিপের জন্য রিটার্ন জমা দেবেন, তারা নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষ।

তবে বিষয়টি নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলছেন, ন্যূনতম আয়কর হিসেবে দুই হাজার টাকা সরকারের কোষাগারে দিয়ে উন্নয়নে শামিল হওয়া গর্বের ব্যাপার। কারণ গরিব মানুষের জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক নয়। টিআইএন বাধ্যতামূলক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য, গাড়ি, বন্দুক কেনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, যাদের ক্ষেত্রে টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক, সেই শ্রেণির মানুষের জন্য এ ন্যূনতম কর বোঝা হওয়ার কথা নয়। পরিবল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, দুই হাজার টাকা করের পদ্ধতি মানুষকে করের সঙ্গে সম্পৃক্ত করবে, অভ্যাস তৈরি করবে। মন্ত্রী আরো বলেন, সরকার যদি ভ্যাট কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে তাহলে এ খাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। আমি সরকারকে বলব সঠিকভাবে এ কাজটি করতে। কারণ ভ্যাট একটি ভালো ট্যাক্স। এম এ মান্নান বলেন, আপনি ভ্যাট না দিতে চাইলে জিনিস কিনবেন না।

বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, বর্তমানে এনবিআর শুধু তাদের কাছ থেকেই কর আদায় করছে, যারা কর দেয়। যারা দেয় না তাদের প্রশ্ন করা হচ্ছে না। এটা সমাজে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করছে। অনেকের করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও রিটার্ন জমা দিচ্ছে না। তাদের করজালে আনতে এ উদ্যোগ যথাযথ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App