নতুন বাজেট ঘোষিত হওয়ার আগেই আমরা কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছিলাম। প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল মুদ্রাস্ফীতির চ্যালেঞ্জ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ। আমাদের দেশে কখনো ডাবল ডিজিটের মুদ্রাস্ফীতি হয়নি। অতীতে সব সময় এটা ৫-৭ শতাংশের মধ্যে ছিল। এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এটা যাতে বেড়ে ১০ শতাংশ বা ডাবল ডিজিট না হয়। সেজন্য বাজেটে অবশ্যই কতগুলো রক্ষাকবচ থাকা উচিত। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো ডলার সংকট। ডলারের দাম হু হু করে বাড়ছে। ডলারের দাম বেড়ে গেলে আমদানির ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এর ফলে এক ডলারের জিনিস আমদানি করলে আগে দাম পড়ত ৮০ টাকা, এখন দাম পড়বে ১১০ টাকার মতো। তার মানে সব আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। আবার জ¦ালানির দামও বেড়ে গেছে। এর ফলে বাইরে থেকে যে জিনিসগুলো আমরা আনছি, তার কস্ট এন্ড ফ্রেইট চার্জ বেড়ে যাবে টাকায়। এ কারণে সব রকম পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়ে যাবে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
তাহলে প্রথম চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি এবং দ্বিতীয়টি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। এটা আবার মূল্যস্ফীতিকে ফুয়েল দিচ্ছে। তার মানে দুটি দুটিকে সমর্থন করে উসকে দিচ্ছে। এর ফলে রপ্তানি খাতে তেমন সংকট না হলেও আমদানিতে সংকট তৈরি করবে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ফলে ডলারের যে ঘাটতি তৈরি হবে, তা পূরণ করতে হলে রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। তার মানে পুরো পরিস্থিতি নির্ভর করবে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর এবং মুদ্রাস্ফীতি কমানোর ওপর। এই বাজেটের সামনে এই তিনটি বিষয়ই চ্যালেঞ্জ।
চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হলো বৈষম্য কমানো। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বৈষম্য হবেই। কারণ পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিতে ধনী আরো ধনী হবে, গরিব আরো গরিব হবে। গরিবরা ধনীর সঙ্গে সব সময় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকবে। এবারের খানা আয় ও ব্যয় জরিপে তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। আয়বৈষম্য আমরা যেটা দিয়ে মাপি, সেই জিনি সহগ ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৪৫। ২০২২ সালের জরিপে সেটা দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯। কোনো দেশে আয়বৈষম্য দশমিক ৫০ হলে সেই দেশটি বিপদে পড়ে। কারণ তখন অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। সে কারণে স্থানীয় বাজার সংকুচিত হয় এবং রপ্তানির ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু কোনো কারণে রপ্তানি ও আমদানির স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে সমগ্র অর্থনীতি ভার বহন ক্ষমতা হারায়।
এই পরিস্থিতি এবং আগে উল্লেখ করা পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখলে বলতে হবে, একই সঙ্গে মন্দা এবং মুদ্রাস্ফীতির চ্যালেঞ্জটা আছে। এখান থেকে পরিত্রাণের সাময়িকভাবে সহজ উপায় হলো বিদেশি ঋণ। কিন্তু যখন এই ঋণ শোধ করতে হবে তখন সংকট দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। সেজন্য আইএমএফের যে ঋণটা সরকার এবার নিয়েছে সেটার বিষয়ে আমাদের সতর্কবাণী ছিল যে, এর সঙ্গে যেসব শর্ত আছে সেগুলো নিয়ে ভালো দর কষাকষি করে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হলো প্রবৃদ্ধি ঘটাতে হবে। তা না হলে কর্মসংস্থান হবে না এবং বেকার তৈরি হবে। সেটা জনগণের মধ্যে আরো অসন্তোষ তৈরি করবে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে বিনিয়োগের ওপর। এই বিনিয়োগে খুব বেশি অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এরপর আছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ। এই বাজেটেরই কয়েক মাস পর অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। তাতে ‘আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব’- তা বাস্তবায়িত হবে কিনা তা এখনো প্রবলভাবে অনিশ্চিত। আর তা না হলে অস্থিতিশীলতার এক সংকট দেখা দেবে।
নির্বাচনকে ঘিরে এরই মধ্যে বিদেশিদের প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি ভিসা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সরকারের ওপর প্রবল চাপ দিয়েছে আমেরিকান সরকার। পাশাপাশি রয়েছে আইএমএফের ঋণ-শর্তাবলির প্রবল চাপ। এ ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হলে প্রয়োজন মৌলিক অর্থনৈতিক সংস্কার। অবশ্য সেগুলো ধনিক শ্রেণি, অসৎ আমলা এবং অসৎ ব্যবসায়ীরা বিরোধিতা করবে। জনগণকে আস্থায় নিয়ে তাদের কাছে স্বচ্ছভাবে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে সরকারও এসব মৌলিক সংস্কারের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারবেন না। সরকারের ধনিক অভিমুখী, শহর অভিমুখী, বিদেশি গোষ্ঠী অভিমুখী প্রবণতাসমূহ না বদলালে এসব সমস্যার আদৌ কোনো সমাধান সম্ভব নয়।
এই সামগ্রিক চ্যালেঞ্জগুলো সামনে রেখে বিচার করতে হবে- প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো?
এবারের বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ৫ লাখ কোটি টাকা। তার মধ্যে এনবিআর তুলবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মানে ৮৫ ভাগ আসবে কর থেকে। প্রশ্ন হলো, এই করটা আসবে কোথা থেকে। আমাদের পরামর্শ ছিল এটা যাতে প্রত্যক্ষ কর সম্পদ কর থেকে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হয়। কিন্তু রাজস্ব আয়ের যে বিবরণী আমরা দেখলাম, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কতগুলো অদ্ভুত নিয়ম করেছে। বর্তমানে ৭০ লাখ মানুষের টিআইএন আছে। এর মধ্যে ৩০ লাখ ট্যাক্স দেয়। বাকি প্রায় ৪০ লাখ দেয় না। এখন সরকার বলছে, সবাইকে ট্যাক্স দিতে হবে। টিআইএনধারী মানুষের সংখ্যা ৭০ লাখ। কিন্তু আমরা জানি যে, আয়কর শুধু তারাই দেবে, যাদের আয়কর মুক্তসীমার ওপরে। আগে করমুক্ত সীমা ছিল ৩ লাখ টাকা। তার মানে, কেউ যদি মাসে ২৫ হাজার টাকার ওপরে আয় করেন, তাহলে তিনি কর দেবেন। এখন এটা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। তার মানে মাসে যদি ৩০ হাজার টাকা আয় করে তাহলে তাকে কর দিতে হবে। কিন্তু এখন যে ব্যবস্থা করেছে, তাতে কেউ ৩০ হাজার টাকার কম আয় করলেও তাকেও ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। তার মানে কিছুতেই সে কর জাল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। কিন্তু এ ধরনের মানুষের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা নেয়ার চেয়ে যে রাঘববোয়ালরা ওপরে আছে, অর্থাৎ ওপরের ১০ শতাংশ অতি ধনীর কাছ থেকে উচ্চ হারে কর নেয়া উচিত। কিন্তু উল্টো তাদের কিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে। যেমন সম্পদ করের সীমা আগে ৩ কোটি টাকা ছিল, এবার তা ৪ কোটি করা হয়েছে।
তার ফলে এই বাজেটের যে চরিত্র যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো গরিবের কাছ থেকে সমূলে কর আদায় করো আর বড়লোকদের কাছ থেকে তুলনামূলক কম কর আদায় করো। আর চাপ বেশি থাকলে সবাইকে কর দিতে হবে- এই স্লোগান তুলে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে একটা টাকা করের মধ্যে ফেলে দাও। সেই অর্থে এই বাজেট মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তকে আক্রমণ করেছে বেশি।
কৃষিতে কিছু উন্নতি বর্তমান সরকারের আমলে আমরা দেখেছি। কিন্তু এই উন্নতির ফল মেহনতি কৃষক-ক্ষেতমজুর পান না। গ্রাম থেকে যে পণ্য শহরে আসে তার যথাযথ দাম উৎপাদক কৃষক পান না। উৎপাদক কৃষক ও ভোক্তারা উভয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন। শহরের যেই পণ্য ভোক্তা কৃষক ক্রয় করেন তারা তার জন্য অনেক টাকা দাম দিতে বাধ্য হন। বর্তমানে কৃষক তার যৌথ বনভূমি, জলাভূমি এবং এমনকি নিজস্ব আবাদি জমিও বিভিন্ন প্রকার পরিবেশ দস্যু, ভূমি দস্যু ও নদী খেকোদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারছেন না। একমাত্র করোনার সময় শহর থেকে মধ্যবিত্ত-নি¤œবিত্তরা এবং কিছু উচ্চবিত্তও গ্রামে ফিরেছিলেন। এখন কিন্তু তারা শহরে ফিরে এসে যথাযথ মাত্রায় কাজ এবং আয় করতে পারছেন না। শহরে জিনিসের এত দাম বেড়ে গেছে যে এটা কেনার ক্ষমতা শহুরে মধ্যবিত্তের থাকছে না। ফলে নতুন গরিব সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামের দরিদ্ররাও কোনো মতে ধনীর জমি বর্গা নিয়ে বা অকৃষি খাতে মজুরি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে বা মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। এই শ্রমজীবী গ্রামীণ গোষ্ঠী কম খেয়ে, বেশি কাজ করে ও ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বেঁচে আছেন।
বাজেটে তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার যে বরাদ্দ আছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। যে ক্ষুদ্রঋণ বহুদিন ধরে চলছে তাতে মাত্র ১০ শতাংশের পক্ষে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়া সম্ভব হয়েছে। ৯০ শতাংশ ঋণগ্রস্ত তিমিরে নিমগ্ন হয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ঋণ ও সামাজিক অধিকার যথাযথভাবে বাড়ানোর জন্য রাজস্ব উদ্বৃত্ত সরকারের নেই। যদিও কিছু ছিটেফোঁটা বরাদ্দ পাইপে ঢালা হয়, ছিদ্রপথে তথাকথিত সিস্টেম লস হিসেবে তার বড় অংশই বেরিয়ে যায়। নিচের তলায় তৃণমূলে দরিদ্রদের হাতে পৌঁছায় না। বিশাল আকারের বাজেটে ঘাটতির অঙ্কটাও অনেক বড়। এই ঘাটতি মেটাতে সরকার ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি ব্যাংক থেকে নেবে অথবা ছাপাবে। এতে মুদ্রাস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা আছে।
আরেকটা হলো ডিসেম্বর মাসে আইএমএফের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, যেটা এখন সর্বনি¤œ ৩০ বিলিয়ন ডলার, এটাকে বাড়াতে না পারলে ওই টাকাটা শোধ করা কষ্ট হবে। আবার টাকা শোধ করতে না পারলে তখন আবার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে। আর সেটা হলে খাদ্যপণ্য, ভোজ্য তেল, মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল এবং আরো যেসব আমদানি পণ্য দরকার এগুলো আনা সমস্যা হতে পারে। সুতরাং একইসঙ্গে অনেকগুলো প্রবল চাপের কারণে অর্থনীতি একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই ঝুঁকিগুলো মোকাবিলার জন্য এই বাজেট উপযুক্ত হয়নি বলে আমি মনে করি। সেটা অবশ্য প্রমাণসাপেক্ষ। আগামী ডিসেম্বেরের মধ্যেই যখন আইএমএফের চাপটা বাড়বে, তখনই কিছুটা বুঝতে পারব- এই বাজেট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সক্ষম হলো?
এম এম আকাশ : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।