×

মুক্তচিন্তা

সরল অঙ্কের বাজেট আমাদের ঋণ করে ঘি খাওয়ার বাজেট

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৩, ১২:৫২ এএম

সরল অঙ্কের বাজেট আমাদের ঋণ করে ঘি খাওয়ার বাজেট

আগামী অর্থবছরের মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব খাতবহির্ভূত (নন-এনবিআর) থেকে আয় হবে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে (এনটিআর) ৫০ হাজার কোটি টাকা। ফলে প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। জিডিপির অংশ হিসেবে ঘাটতি পরিমাণ ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এই ঘাটতি ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ, বৈদেশিক সাহায্য ও অনুদান এবং সঞ্চয়পত্রের বিক্রির অর্থ দিয়ে মেটানো হবে। ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বিশাল বাজেট কীভাবে অর্থ সংস্থান করবে সরকার, তার রূপরেখা হলো বাজেট নামের ঘোষণাপত্র। এটি আমাদের চলমান জীবনের যে রাজনৈতিক পরীক্ষা, সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সরল অঙ্ক। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, মাধ্যমিক ছাত্রজীবনের সরল অঙ্কের কথা। আমরা প্রথমেই চেষ্টা করতাম, সরল অঙ্কটি কষে নেয়ার। কারণ, সেখানে পাক্কা ১০ নম্বর। সেই নম্বরের জোরে রেজাল্ট স্টার মার্কে পৌঁছাতে সবচেয়ে বড় সহায়ক হতো। আজকে আমাদের সরকার যে পরীক্ষাটিতে বসেছে, সেখানে সরল অঙ্কটি দিয়েই শুভ সূচনা করতে হয়। মূলত জাতিকে আশ্বস্ত করার জন্যই সরকার আয়ের উৎসগুলো দেখায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমেই মূলত আয় সব থেকে বেশি। কিন্তু মূসক বা ভ্যাটের আওতা না বাড়ালে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব না। ছিটেফোঁটা দিয়ে আয়কে বাড়ানো খুবই কঠিন। কর বাড়ানোর চেয়ে করের আওতা বাড়ানোর বিকল্প নেই বললেই চলে। কত বিপুল এলাকা যে করমুক্ত রয়ে গেছে, তা আমরা মানে সাধারণ মানুষ জানেনই না বা বোঝেনও না। এটা সেই সরল অঙ্কের জটিল সমাধানের একটি পর্ব। এই পর্বটি সম্পন্ন করা গেলে বোধহয় শেষ সুফল মিলবে। এই কর আহরণ সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ৬৮ শতাংশ নাগরিক তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত আয়ের করই দেয় না। কারণ কিছুই না, তাদের আয় সরকার নির্ধারিত চাঙ্কের নিচে বিধায় তারা কর নিয়ে ভাবেন না। আসল সত্য হচ্ছে, কর দেয় না এমন লোকদের আওতাভুক্ত করতে যে কাজটি করতে হবে, তাকে ভয় পান সেক্টরের লোকেরা বরং বিপুল অঙ্কের আয়করদাতাদের কাছে থেকে মাল নিয়ে তাদের কাছে থেকে সামান্য বিনিময়ে ছাড়পত্র দেন। ফলে আয়ের উৎস খাটো হয়ে যায়। শিল্পপতি বা ওই সেক্টরের পতিদের কাছে থেকেও ঘুষের বিনিময়ে কম আয় করেন সরকারের জন্য। এটা এক বিরাট সমস্যা। কিন্তু তারা যা আয় করেন, সেই আয় করযোগ্য হোক বা না হোক রিটার্ন যদি তারা উপস্থাপন করেন, তাহলে প্রকৃত সত্য পাওয়া সহজ হয়। ওই ৬৮ শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত আয়ের কর না দেয়ায়, তারা যেমন জাতির প্রয়োজনে অবদান রাখতে পারছেন না, তেমনি জাতিও তাদের জন্য ভালো কিছু, কল্যাণকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এতে বিশাল অঙ্কের ঘাটতি থেকে যায়। রাজস্ব ঘাটতি হলে তা মোকাবিলা করা হয় করবহির্ভূত এলাকা থেকে। যেমন সরকার দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে রাজস্ব ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে। তাতেও যদি না কুলায়, তাহলে বৈদেশিক সাহায্য ও অনুদান থেকে অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। এই ব্যবস্থা হচ্ছে ঋণ করে ঘি খাওয়ার একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতি খুবই খারাপ একটি পথ। কারণ, বেলাশেষে সরকারকে মোটা অঙ্কের অর্থ সুদাসলে ফেরত দিতে হয় ঋণদাতাদের। সেটা খুবই কষ্টসাধ্য। কারণ সরকারের আয়ের পথ/উপায় তো বেশি না। আর সরকার তো ব্যবসা করে না, তার রাজনৈতিক উৎস থেকে আয় হওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে এই ঋণ করে ঘি খাওয়ার অর্থনৈতিক পদ্ধতিটির আবিষ্কার কে বা কারা? এই যে গড় করে ব্যক্তিগত আয় দেখানোর রাজনৈতিক অর্থনীতির পদ্ধতিটি যিনি রচনা করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কারণ, ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে মিথ্যা একটি আশ্বাস রচনা করা যায়, একজন ব্যক্তিও অনেক টাকার মালিক। আসলে তো সে কোনো টাকাই চোখে দেখেনি। তবু তার নামে ওই আয়টি ধার্য করা হয়েছে। মাথাপিছু আয়ের অঙ্কটিও ওই শ্রেণির। ফলে যারা অঙ্ক ও তার অর্থের রূপ দেখিয়ে জাতিকে বলেন, ওই ফকির লোকটিও একজন ধনীর সমান আয় করেছেন, তখন হাসি আর কান্নার একটি মিশ্র চিৎকার আমরা শুনতে পাই। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা : আগামী বাজেটে সার্বিক ঘাটতি হবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণপ্রাপ্তির প্রস্তাব করা হয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) যা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় এটির বিক্রিতে চলতি বছরে ধস নেমেছে। ফলে সংশোধিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেট যে ঋণ করে ঘি খাওয়ার পরিকল্পনা, এটা নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই। এই ঋণ করে বাজেট ঘাটতি মোকাবিলার পরিকল্পনার পেছনে উন্নয়নের গল্প দেয়া হয়, কেন না সরকার সেই গল্প সহজেই জনগণের চোখে স্বপ্ন রচনা করে তা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। আসলে ওই গল্প কেবল গল্পই, বাস্তব নয়। ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে হয় সুদে-মূলে। অতএব, বছর শেষে সরকারকে বিশাল অঙ্কের টাকা গুনতে হয়। তাতে কোনো ক্ষতি নেই, কেবল দুশ্চিন্তার একটি পদ্মা-যমুনা নদী সরকারের কপালে বইতে থাকে। আর সেই ধকল সরকারকে নানা আকথা-কুকথা বলতে বাধ্য করে। সেটা রাজনৈতিক মঞ্চ থেকেই বেশি বলা হয়। তাতে সুবিধা হচ্ছে, রাজনৈতিক মঞ্চের কথা সব সময় কাউন্টেবল নয়, বক্তৃতার জন্য বলা। মঞ্চের বক্তৃতা আর সরকার চালানোর নকশা এক নয়, বহু ফারাক আছে। সেটা আমরা বুঝতে চাই, বলতেও চাই। কেননা, কথা বলার অধিকার আমাদের আছে, সেটা সংবিধানেই দেয়া আছে। কাজীর খাতার তালিকার মতো, খাতায় আছে, আসলে গোহালে নেই। এই যে ঋণ করে ঘি খাওয়ার দলিলটি উপস্থাপন করেন সরকারের অর্থমন্ত্রী, এটির রচয়িতা তিনি নন, তার চারপাশে যারা বিদ্বৎগণ আছেন, মানে আমলাগণ, তারাই তার রচয়িতা। তবে অর্থমন্ত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ওই দলিল পাঠ করে শোনাতে হয়। এই দলিল পাঠের আগেই শুরু হয়ে যায়, যা সরকারের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সমালোচনা। সেই আলোচনায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণ তাদের মূল্যায়ন করেন। মানে সার্টিফিকেট দেন। সেই সার্টিফিকেটের পক্ষে-বিপক্ষের কথাগুলো কোনো কাজে আসে কিনা, শুনিনি কখনো। জাতির আয় ও ব্যয়ের হিসাব দেয়ার এই পদ্ধতিটি ঔপনিবেশিক চিন্তা ও ভাবনারই অনুবর্তনমাত্র। এর বাইরে আর কি পদ্ধতি হতে পারে, তার কোনো উদ্যোগ-আয়োজন দেখা যায় না। আমাদের অর্থনীতিবিদরা যেসব কারিকুলামের জ্ঞানে সিক্ত, তার বাইরে যেতে ভয় পান। কারণ তাদের ইনোভেটিভ কোনো সাধনা নেই, চিন্তা করার সাহসও নেই। তবে মানুষকে শোষণ করতে হবে কেমন করে, সেই বিদ্যার অনুবর্তনই তারা বহন করেন। এই লিগেসির অবসান হওয়া উচিত। তাহলে যে আমলাতন্ত্র আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে, তারা যে বিশাল অঙ্কের অর্থ নিয়ে যায়, যা অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয়, বাজেটে তারাই প্রধান প্রাপক বা খাতক। জনগণকে চরম দুর্ভোগ দানই তাহাদের প্রশাসনিক কাজ। এই প্রশাসন ব্যবস্থা বিপুল ব্যয়বহুল, ক্ষমতায় টিকে থাকার দাওয়াই হিসেবে রাজনৈতিক সরকারও তাদের জন্য বিশেষ বিশেষ প্রণোদনা দেয়। কিন্তু তাদের সেই ব্যয়ের বিপরীতে আয় শূন্য। এই শূন্য আয়ের সেক্টরটিকে ছোট আকারে নিয়ে আসার কোনো পদ্ধতি নেই। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে আমলাতন্ত্রের লোকদের দৌরাত্ম থামানো যেতে পারে। তাতে বলা হবে, মানুষ অনেক চাকরি হারাবে। তা ঠিক, তবে ওই জনশক্তিকে নতুন উৎপাদনের সেক্টরে নিয়োগ করা গেলে দেশের উন্নতি হবে বেশি। আমি বা আমরা চাকরি খাওয়ার পক্ষে নই, তাদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের পক্ষে। তাদের শারীরিক-মানসিক-মানবিক-সাংস্কৃতিক মেধা বিকাশের পক্ষে আমরা। আলস্য আমাদের জাতিগত, মানে জিনেটিক/ জিনগত সমস্যা, আমার ধারণা। কিন্তু সেই আমরাই যখন ইউরোপ-আমেরিকায় যাই বা সেখানে কাজ করি, আমাদের মেধার নতুন বিকাশ ঘটে এবং আমাদের উন্নতির একটি ভিত্তি খুঁজে পাই। অথচ গত ৫২ বছরে সিঙ্গাপুরের সমান হতে পারিনি। এর জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম। এই শিক্ষা খাতে ব্যয়-বরাদ্দের চেয়ে সামরিক খাতের বরাদ্দ বেশি। আমাদের দেশের চারপাশে যারা আছে, তারা কি আমাদের শত্রæ যে তাদের সামরিকভাবে মোকাবিলার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার সামরিক সরঞ্জাম কিনতে হবে? লালন-পালন করতে হবে লাখ লাখ সামরিক সদস্য, যারা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে। দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে আয়ের চেয়ে ব্যয় যারা বেশি করে, তাদের জন্য এই বাজেট উৎকৃষ্ট, সন্দেহ নেই। অথচ এ দেশের মালিক হচ্ছে জনগণ, যারা সাদা নামে কৃষক, রাজনৈতিক নামে শ্রমজীবী মানুষ। এদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর তেমন কোনো মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই বাজেটে এবং সেক্টরের বহুধাবিভক্ত উন্নতির রূপরেখায় বিনিয়োগের বিশাল প্রমাণও নেই। ফলে পরীক্ষার খাতায় আমরা সরল অঙ্কটি কষব কেমন করে?

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App