×

মুক্তচিন্তা

একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আমাদের করণীয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৩, ১২:৫০ এএম

একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আমাদের করণীয়

এটা অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ, আগামী ১৯ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৫৩তম অধিবেশনে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত ইতিহাসের জঘন্যতম জেনোসাইড আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আলোচ্যসূচিতে এজেন্ডাভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের এজেন্ডা আলোচ্যসূচিভুক্ত হয়েছে তিন নম্বর বিষয় হিসেবে। এ ইস্যুটা বাংলাদেশের জন্য, এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য, একাত্তরের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে বিশ্ববাসীকে অধিকতর তথ্য দিয়ে অবহিত করার জন্য, একাত্তরের লাখো শহীদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য এবং আগামী প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের সঠিক চিত্র উপস্থাপনের জন্য একাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের এবং জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভীষণ জরুরি। আমি ঠিক জানি না বাংলাদেশের মিডিয়া এ ইস্যুটির যথাযথ গুরুত্ব উপলব্ধি ও অনুধাবন করতে পারে কিনা। কেননা এর গুরুত্ব আমরা যদি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম, তাহলে এরকম একটি সংবাদ বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় এক কলামের ‘মিনি নিউজ’ হিসেবে ছাপা হতো না কিংবা ভেতরের কোনো এক পাতায় ‘মফস্বলীয় অবহেলায়’ ছাপা হতো না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের আবেগ, আমাদের ভালোবাসা এবং গৌরব যেন কোনোভাবে না কমে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের মনে, মননে এবং চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐহিত্য এবং উত্তরাধিকার যে মাত্রায় পুনরোত্থিত হয়েছিল, সেটা যেন কোনোভাবে মøান না হয়ে যায়। এ সবকিছুর সার্বিক বিবেচনায়, ১৯৭১ সালের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভীষণ গুরুত্ব বহন করে; বিশেষ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৫৩তম অধিবেশনে যদি এ স্বীকৃতি আসে, সেটা হবে অনেক বড় অর্জন। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি- ‘জেনোসাইড’কে বাংলা করে ‘গণহত্যা’ লেখা হয়। এটা তত্ত্বীয়ভাবে, ঐতিহাসিকভাবে এবং বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় একটি ভুল প্রতিশব্দ। কারণ গণহত্যার ইংরেজি হচ্ছে ‘মাস কিলিং’; জেনোসাইড নয়। প্রকৃত অর্থে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের জেনোসাইড সনদ ও ১৯৯৮ সালের রোম-স্টেটিউটে, জেনোসাইডের যে সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ‘গণহত্যা’ বা ‘মাস কিলিং’, জেনোসাইডের একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। তাই জেনোসাইডের যদি যথাযথ বাংলা প্রতিশব্দ আমরা না জানি, আমাদের উচিত ‘জেনোসাইড’ বলা, কিন্তু কোনোভাবেই ‘গণহত্যা’ নয়। কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত জেনোসাইড জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের এজেন্ডায় পরিণত হলো এখানে তার খানিকটা প্রেক্ষাপট আলোকপাত করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানদের সংগঠন ‘স্টিচিং বাসুগ’ নামের একটি বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ আছে, যারা জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের বিশেষ পরামর্শকের মর্যাদা পায়। তাদের সঙ্গে ‘আমরা একাত্তর’, ‘প্রজন্ম একাত্তর’, ‘ইউরোপীয় বাংলাদেশ ফোরাম’ এবং ‘সিরাজী ফাউন্ডেশন’ একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের কাছে একটি আবেদন পাঠিয়েছিল। গত ২৯ মে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের পাঠানোর যৌথ আবেদনপত্রটি গ্রহণ করেছেন বলে জাতিসংঘ অফিসিয়ালি এক বিবৃতির মাধ্যমে জানান দেয়। বিবৃতিটি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের রেজ্যুলেশন ১৯৬৩/৩১ অনুযায়ী প্রচার করা হয়। বিবৃতির ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের চালানো বাঙালিদের ওপর জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবির বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের আগামী অধিবেশনের (৫৩তম অধিবেশনে) আলোচ্যসূচিতে রয়েছে। এটি অধিবেশনের আলোচ্যসূচির ৩ নম্বরে রয়েছে। অধিবেশনে সব ধরনের মানবাধিকার, নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা হবে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৫১তম অধিবেশনে বাংলাদেশের একাত্তরের জেনোসাইডের বিষয়টি এজেন্ডা হয় কিন্তু তখন স্বীকৃতি মেলেনি। তখনো এটা তিন নম্বর এজেন্ডা হিসেবে আলোচ্যসূচিভুক্ত ছিল। তখনো ‘আমরা একাত্তর’, ‘প্রজন্ম একাত্তর’, ‘ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ ও নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রবাসী সংগঠন ‘বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ’ প্রায় ৯ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের আবেদনের সপক্ষে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তোলার কাজ করে। বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, প্রদীপ প্রজ্বালন, পোস্টার প্রদর্শনী, ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী এবং জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোর মিশনে স্মারকলিপি দেয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করা হয়। কিন্তু ৫১তম অধিবেশনেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না মিললেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও পাকিস্তানি মিলিটারি কোন মাত্রার গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ করেছিল, তা বিশ্ববাসীর সামনে নতুন করে যথাযথ তথ্য-প্রমাণসহ উপস্থাপিত হয়েছে। সুতরাং ১৯৭১ সালে সংঘটিত জেনোসাইডের জাতিসংঘের স্বীকৃতি না মিললেও বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা অর্জন করতে পেরেছিল এবং সেটাই ৫৩তম অধিবেশনের বাংলাদেশের আবেদনকে অধিকতর শক্তিশালী ও মজবুত করেছে। এখানে মনে রাখা জরুরি, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের পার্লামেন্ট ২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যার ভয়াবহতাকে স্মরণ করার জন্য ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে কেবল বাংলাদেশ ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন করে কিন্তু এটা যদি আন্তর্জাতিক ফোরামে বিশেষ করে জাতিসংঘের মাধ্যমে স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়, তাহলে জাতিসংঘভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলোও এটাকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করবে। যখন বিশ্বব্যাপী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐহিত্য ও রাজনীতি আলোচিত হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট আলোচিত হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আলোচিত। পাকিস্তারের নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের ইতিবৃত্ত আলোচিত হবে। এ দেশের মানুষের বীরোচিত সেক্রিফাইস এবং মহান আত্মদানের ইতিহাস আলোচিত হবে। পৃথিবীর মানুষ জানতে পারবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম সেক্রিফাইসের মধ্য দিয়ে একটি পতাকার জন্ম হয়েছিল। এক কোটি মানুষের শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং প্রায় ২ কোটি মানুষের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হওয়ার ভেতর দিয়ে অমানবিক কষ্টসহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ রকম নানা কারণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত নিষ্ঠুর নির্যাতন, নির্মম হত্যাযজ্ঞ, নির্বিচার ধর্ষণ-লুণ্ঠন এবং পাইকারি অগ্নিসংযোগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জরুরি। এখানে মনে রাখা জরুরি, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও এখনো আমাদের কেন ১৯৭১ সালে সংঘটিত জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন করতে হয়। জাতিসংঘের স্বীকৃতির জন্য উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। তার চারটি কারণ আছে বলে আমি মনে করি। প্রথম কারণ : স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশাধিক বছরের শাসনামলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য শক্তিগুলো এ দাবির পক্ষে কোনো কার্যকর অবস্থান গ্রহণ করেনি। দুঃখজনকভাবে আওয়ামী লীগের বাইরের শক্তিই এ দেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল বেশি সময় ধরে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রায় ১৫ বছর (১৯৭৫-১৯৯০) সামরিক শাসন, বিএনপির ১০ বছর (১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬) এবং ফরুদ্দিন-মইনুদ্দিন দুই বছর (২০০৬-২০০৮)। সবমিলে প্রায় ২৭ বছর। এ সময়কালে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের স্বীকৃতি তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির প্রতিযোগিতা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি মিলতে আমাদের অর্ধশতাব্দী লেগে যায়। দ্বিতীয় কারণ : মুক্তিযুদ্ধের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যে পরিমাণ এবং গুণগত মাত্রায় গত ৫০ বছরে আমাদের পৌঁছানোর কথা সে মাত্রায় এবং সংখ্যায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি। তৃতীয় কারণ : আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে পরিমাণে উদ্যোগী হওয়া জরুরি ছিল, সে পরিমাণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের একাত্তরের বার্তা আমরা পৌঁছে দিতে পারিনি। চতুর্থ কারণ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কয়েকটি ভালো মানের মৌলিক কাজ হয়েছে, সেগুলো প্রধানত বাংলা ভাষায় যার যথাযথ অনুবাদের কোনো উদ্যোগ কোনো পর্যায়ে গ্রহণ করতে আমরা দেখিনি। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গত ৫০ বছরাধিক সময়ে যে মাত্রা, পরিমাণ এবং গুণগত মান নিয়ে পৌঁছানোর কথা, সেটা আমরা পারি না। তাই সার্বিক বিবেচনায় জাতিসংঘের আগামী ৫৩তম অধিবেশনে যাতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি পায়, সেজন্য এখন থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি এবং প্রচারণা শুরু করা জরুরি। ব্যক্তি পর্যায়ে, সাংগঠনিক পর্যায়ে এবং সরকারি পর্যায়ে দেশে-বিদেশে যে যেখানে আছেন, সবারই দায়িত্ব হচ্ছে সম্মিলিতভাবে এ মিশনে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত হওয়া। আমরা একাত্তরে সংঘটিত ‘জেনোসাইড’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App