×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক প্রত্যাশা ও তরুণদের আত্মবিয়োগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩, ০৮:২৩ পিএম

সামাজিক প্রত্যাশা ও তরুণদের আত্মবিয়োগ

কাজী বনফুল- লেখক ও কলামিস্ট।

কিছুদিন আগে একটি ছেলে মেঘনা নদীতে লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নিজেকে বিলীন করেছে অসীম শূন্যতায়। ছেলেটির হারিয়ে যাওয়ার সেই মূহুর্তের সিসিটিভি ফুটেজটি দেখলাম এবং ভিডিও টি দেখার পর হৃদয়ের গভীরে এক অতৃপ্ত চাপাঁ কষ্ট অনুভূত হচ্ছে । এমন তাঁজা পুষ্পের মত জীবন এত সহজেই হারিয়ে গেল কিন্তু কেন? কেন আমাদের মাটির ছেলেরা কিছুদিন পরপর এমন করে হারিয়ে যায়, যারা আমাদের স্বপ্নের সারথি হওয়ার কথা ছিল, যারা হবে পরবর্তী দিকপাল, পথপ্রদর্শক কিন্তু কেন তারা মুখ লুকায় অজানা দিগন্তে ! এই হারিয়ে যাওয়ার মূল কারন আমাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিৎ।

মানুষ আসলে দুই ভাবে হারিয়ে যায় এক: মানসিক ভাবে, দুই: শারিরীক ভাবে।

একটা মানুষ মানসিক ভাবে হারানোর পরই সে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে শারীরিক প্রস্থানের। আর সেই দৃশ্যমান শারিরীক প্রস্থানকেই আমরা অপমৃত্যু বলি। মৃত্যুর আগে অপ শব্দটিকে যোগ করে আমাদের এই সমাজ বিবেক ও শব্দ বিশারদরা বুঝাতে চেয়েছেন যে এটা একটা খারাপ মৃত্যু এবং এই মৃত্যুর পথ বেছে নিয়ে সে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে। তাই তারা এই মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে নামকরণ করেছেন।

ছেলেটার যখন প্রথমে মানসিক মৃত্যু ঘটেছিলো তখন সে হয়তো শারীরিক মৃত্যুকে এড়ানোর জন্য বিভিন্ন জীবন বাঁচানোর বিপনি প্রতিষ্ঠান, এবং সেই সাথে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট গিয়েছিল একটু বেঁচে থাকার আশ্রয়ের খোঁজে, কিন্তু তারা হয়তো আশা দিয়েছিল, সান্তনা দিয়েছিল, কিন্তু কোন সুযোগ বা মুক্তি দেয়নি। কিন্তু মৃত্যুর পরে তারাই শব্দগত ভাবে নাম দিয়েছে অপমৃত্যু বা খারাপ মৃত্যু।

যে ছেলেটি নিজেকে হত্যা করেছে তার একটি ভালো ও স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য যে মসৃণ ও প্রসস্থ পথের দরকার ছিল সেটা কি সে আদৌও পেয়েছে? পায়নি বরং আমাদের সমাজ এবং সামাজিক চাপের কারণে স্বয়ং তার পরিবারও তার জীবনটাকে সর্বদিক দিয়ে করেছে বিপর্যস্ত, আকাশ সমান বোঝা তার মাথায় উঠিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চেয়েছে সবাই।

আমাদের সমাজব্যবস্থা আজ এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে যেখানে একটা পড়াশোনা শেষ করা ছেলে-মেয়েকে মাপা হয় একটি নির্দিষ্ট চাকরির গন্ডিতে। তার বাইরে তার কোন স্থান নেই, তার কোন জীবন নেই, অনুভূতি নেই, কোন সম্মান নেই, কোন অবস্থান নেই। আমি একবার এক অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম একজন চিত্রশিল্পীর বসার চেয়ারটা কেড়ে নিয়ে একজন ভয় দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করা ব্যক্তিকে চেয়ারটাতে বসতে দেওয়া হয়েছিল।

আরেকবার এক অনুষ্ঠানে একজন সুরকারকে দেখেছিলাম অনুষ্ঠানের এক কোনে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। কেউ তার সাথে কথা পর্যন্ত বলছে না কারণ তার ভয় দেখানোর ক্ষমতা শূন্য। সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হচ্ছে সেই সব ব্যক্তিবর্গ যাদের মানুষকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজ শুধুমাত্র তাদেরই মূল্যায়ন করছে যারা কোন না কোন ভাবে মানুষকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে।

আমাদের কর্মক্ষেত্রের পরিধি পরিনত হয়েছে ভয় দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করার উপরে। তাই সমাজ ও পরিবার চায় পড়াশোনা করা ছেলে-মেয়েটা এমন কিছু করুক যাতে তাকে দেখে মানুষ ভয় পায় যার সম পরিমাণ ভয় দেখানোর ভাগ তারাও ভোগ করতে পারে। এজন্য আমাদের সমাজের অন্য সকল পেশাজীবি মানুষ কোন রকম মুখ লুকিয়ে বাঁচে।

প্রদোষের আলোয় যেমন সব কিছু আবছা ও ভাসা ভাসা দেখা যায় আমরাও ঠিক সেইভাসা ভাসা অবস্থায় আছি ডুবতে আমাদের খুব বেশি দেরি নেই। আমাদের সব কিছু এখন পুরাতন বাংলা খবরের কাগজের ছবির মত অস্পষ্ট ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের এখন আর কোন দার্শনিক নেই, নেই কোন শিল্পী, নেই কোন লেখক, নেই কোন সৃষ্টিশীল মানুষ। এখন আমাদের মানসম্মত কোন কবি নেই যা আছে তা শুধু ছবি আর ছবি। দুই-চার জন সু চিন্তার মানুষ যারাই আছে, তারা কোন রকম গোপনে নিভৃতে জীবনকে অতিবাহিত করছে মাত্র । এক কেন্দ্রিক কর্মের ঝোঁক আমাদের জীবনকে- জীবন থেকে দূর- বহুদূর নিয়ে গেছে। জীবনকে অনুভব বা উপলব্ধি করার এখন আর আমাদের কোন সময় নেই। সবাই কেবলই দৌড়ের উপরে জীবনের মূল্যবান সময় অতিক্রম করছে মাত্র । কেউই বুঝতে পারছে না "জিন্দিগি না মিলে দোবারা"

আজ যে ছেলেটা বেকারত্বের কারণে মেঘনা নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে তার এই আত্মহত্যার মূল কারণ হচ্ছে এই সামাজিক অবমূল্যায়ন। সমাজ তাকে বারবার বুঝিয়ে দিয়েঝে যে পড়াশোনা শেষ করে সে আসলে এখনো কোনপ্রকার ভয় দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। সে একটা অথর্ব সে এই সমাজের বোঝা তাকে দিয়ে সমাজের কোন উপকার হবে না কারন তার ভয় দেখানোর ক্ষমতা শূন্য। তার মানে তার অবস্থানও এই সমাজের কাছে শূন্য। অতএব কোন মানুষই শূন্য অবস্থায় পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়না তাই সে এই পথ বেছেঁ নিয়ে নিজে শূন্যতায় হারিয়ে গিয়ে সমাজকে দিয়েছে পূর্ণতা।

এখন এই সমাজই আবার এই মৃত্যুকে মূল্যায়ন করছে অপমৃত্যু হিসেবে। কিন্তু যে ছেলেটা মৃত্যুর আগে অপ শব্দটা যোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের, তার কি এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে খুব ভালো লেগেছে, তার কি একটুও কষ্ট হয়নি। অবশ্যই হয়েছে সিসিটিভির ফুটেজে দেখলাম ছেলেটা নদীতে লাফ দিতে গিয়ে একবার থেমে গিয়েছে। একটু সময় পুনঃ বিবেচনা করে দেখেছে যে তার কি আসলে বেঁচে থাকার বা তাকে ভালোবাসার মত কেউ একজন এই পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে কিনা, যার ভালোবাসার কারণে হলেও সে এই পৃথিবীতে বেচেঁ থাকবে। কিন্তু ঐ সময়ের ভেতরও যখন তার হৃদয়ে এমন কোন মানুষের ছবি উদিত হয়নি যার কারনে সে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে। যার স্নেহ মমতা ও মায়া ভরা মুখখানার কথা ভেবেও সে হয়তো বেঁচে থাকতে চাইবে এই অলীক পৃথিবীতে। এমন কোন মুখ বা প্রেমময় ছবি তার সম্মুখে উদিত হয়নি, উদিত হলে হয়তো বেঁচে যেতো প্রাণটা।

আমাদের সত্য ভালোবাসা বলতে এখন আর কিছু নেই, ভালোবাসা ও প্রেমের মধ্যেও মিথ্যা ও মুখোশ খুব পাকাপোক্ত ভাবে দানা বেঁধেছে। আর এভাবেই আমরা হারিয়ে যাচ্ছি মুখোশের ভিড়ে।

আত্মহত্যার জন্য যদি আপনার কাছে দশটা কারণ থাকে তেমনি বেঁচে থাকার জন্যও আপনার কাছে হাজারটা কারণ আছে যা আমরা দেখতে পাইনা বলে উপলব্ধি করতে পারিনা। পৃথিবীতে অবশিষ্ট কেউ যদি আপনার ভালোবাসা অনুভব করতে না পারে আপনি অন্তত একটি গাছ কে ভালোবাসে বেঁচে থাকুন দেখবেন সে আপনার ভালোবাসার সঠিক মূল্যায়ন করেছে।

একবার এক ব্যক্তি আত্মহত্যার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে পড়েছিল তার পোষা কুকুরের মায়াভরা মুখখানা। পরবর্তীতে সে আর নিজেকে হত্যা করতে পারেনি। পরবর্তীতে সে তার কুকুরকে ভালোবেসেই বাকি জীবন অতিবাহিত করছে।

আবার অন্য এক ব্যক্তি পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে বলে ঠিক করেছে। পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিবে ঠিক সেই মূহুর্তে বৃষ্টি এসে তার সকল কষ্ট মুছে দিয়েছিল পড়ে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এমন সুন্দর অনুভূতিপূর্ণ পৃথিবী থেকে সে কেন মরবে কার জন্য মরবে। একবার মরলে কি আর সে এই বৃষ্টির ছোঁয়া অনুভব করতে পারবে? পারবে না। সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলো।

যে ছেলেটা নদীতে ঝাপ দিয়ে জীবন জীবন বিসর্জন দিয়েছে, সে নদীর কালো অন্ধকারের চেয়ে এই সমাজ ও তার পরিবারের কালো আচরন ও অবয়বকে বেশি ভয় পেয়েছে। যার কারনে সে এই সমাজ থেকে ছুটি নেওয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছে।

ভাবা যায় একটা উদিত সম্ভাবনাময় জীবনকে আমরা কত সহজে গলা টিপে হত্যা করে ফেলি।

বেকারত্বের অভিশাপ নামক যে শব্দের প্রচলন ঘটেছে আমাদের এই দেশে তা অবশ্যই কোন দৈব ভাবে হয়নি বরং আমরাই আমাদের এই সমাজে এর প্রচলন ঘটিয়েছি। একটা মানুষ যতক্ষন বেঁচে থাকে সে কোন না কোন ভাবে কিছু না কিছু করেই বেঁচে থাকে। একটা মানুষের যতক্ষণ পর্যন্ত তার নিশ্বাস প্রচলিত থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কখনোই কোন ভাবেই বেকার নয়। এমন কি ঘুমের মধ্যেও নয়। আমি এমন একজনের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম যে, ঐ ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেই তার আসল জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিলো। ইতালিয়ান দার্শনিক ভিকোর মতে, 'পোয়েট' শব্দের আদি গ্রীক শব্দের অর্থ হলো সৃষ্টিকর্তা। সেক্ষেত্রে কবিরা হলেন মূলত সৃষ্টিকর্তা। এবং মানুষমাত্রই একেকজন কবি, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার স্মৃতিগুলোকে মনে রাখতে সক্ষম হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সে সৃষ্টিশীলতার ভেতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে।

তাহলে কে বা কারা এই অভিশাপ নামক অপবরটি আমাদের মাটির ছেলেদের উপর অর্পণ করলো। কারা এই অভিশাপ দিয়ে ধ্বংস করে দিল লক্ষ লক্ষ তরুণ সম্ভাবনাময় প্রাণ। তবে হ্যাঁ তারা এটা বলতে পারে যে তাদের অবারিত প্রয়োজন মিটাতে ব্যর্থতার কারণেই তাদের উপর বেকারত্বের অভিশাপের বর অর্পিত হয়েছে।

আমাদের সমাজে একজনের জীবনে অন্যের হস্তক্ষেপ, একজনের চিন্তা, চাওয়া-পাওয়া অন্যের মাধ্যমে পূরণ করার এই যে প্রবনতা এটা একটা মারাত্মক অপরাধ যা আমাদের সমাজে ব্যপকহারে বিস্তার লাভ করেছে।

এই খারাপ মৃত্যুর দায় আমরা কোন ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবো না, কোন ভাবেই এই মৃত্যুর হত্যাকারী হিসেবে এই সমাজ তার দায় এড়াতে পারে না। এর সম্পূর্ণ দায় এই সমাজ ব্যবস্থার যার কারনে এভাবে কিছুদিন পরপর এভাবে হারিয়ে যায় নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল প্রদীপেরা। অথচ এই প্রদীপগুলোর সম্মেলিত আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হতে পারতো সমগ্র বিশ্ব বিবেক।

আইনস্টাইনকে তার স্কুলের স্যাররা বলতেন অলস কুকুর তার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। আইনস্টাইনের উপর সকলে মিলে অনেক অত্যাচারও করতো সে সময়। কিন্তু আইনস্টাইন যদি তাদের কথার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেকে অলস কুকুর মনে করেই কাটিয়ে দিতেন সারাটা জীবন তাহলে হয়তো আমরা এই আধুনিক বিশ্বের ছোঁয়া অনুভব করতাম না। কারন আইনস্টাইন ভেবেছে এটা ঐ শিক্ষকের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র কোন দৈবিক বাণী নয়। মানুষ বা সমাজের মতামতকে নিজের জীবনে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ দিলে সে জীবন আর নিজের জীবন থাকে না তা হয়ে যায় সেই সমাজের দাসত্বের হাতিয়ার। যা আইনস্টাইন উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন এবং তিনি সমগ্র বিশ্বকে তার উদ্ভাবিত থিওরির দাসে পরিনত করেছিলেন।

এই পৃথিবীতে সকল কিছুই ঐন্দ্রজালিক কিন্তু একটা বিষয়ই কেবল সত্য ও সুন্দর আর সেটা হচ্ছে জীবনের অনুভূতি এবং এই অনুভূতির ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রেম,মমতা ভালোবাসা। এই অনুভূতির চেয়ে সুন্দর ও নির্মল আর কিছু হতেই পারে না। একবার এই অনুভূতির দরজায় কড়া নেড়ে দেখুন কত গভীরতা আছে এই অনুভবে। এই পৃথিবীর একটা প্রাণও যেন প্রেম শূন্যতায় না ভোগে। আমাদের শুধুমাত্র প্রেমই দেওয়ার ক্ষমতাই আছে আমাদের আর কিছুই নেই। তাই সকল জীবনকে ভালোবাসুন নিজের জীবনের অনুভূতি দিয়ে দেখবেন জীবন কত সুন্দর, কত আনন্দময় হয়ে উঠেছে।

লেখক: কাজী বনফুল- লেখক ও কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App