×

জাতীয়

নতুন মার্কিন ভিসানীতি: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘কবর’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৩, ০৯:৩৮ এএম

নতুন মার্কিন ভিসানীতি: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘কবর’

ছবি: সংগৃহীত

সদ্য ঘোষিত মার্কিন ভিসানীতির প্রভাব নিয়ে এখনো চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কার জয়, কার পরাজয় হয়েছে- এই নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ হলেও এই ভিসানীতির আলোকে এটা বলাই যায়- বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির ‘কবর’ হয়ে গেছে। দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়ে আসছে; আবার আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন ভিসানীতিকেও স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে এখনো তাদের অবস্থান প্রকাশ করেনি। সব মিলিয়ে নতুন মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ- ‘উইন উইন’ মনোভাব দেখালেও বাস্তবে বিএনপির জন্য আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কিছু নেই এতে।

অপরদিকে নতুন ভিসানীতি কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, কেবল হুঁশিয়ারি- এই ভেবে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে স্বস্তি রয়েছে। তবুও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা এবং সরকারের মন্ত্রীরা একই সুরে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসানীতির বিধিনিষেধ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলের জন্যই প্রযোজ্য এবং একটা সতর্কবার্তা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকার বিচলিত নয়।

ভিসানীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এতে অন্তত চারটি বিষয় রয়েছে, যার কারণে সরকারি দল আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিকে বেশি ভুগতে হবে। তবে ভিসানীতি ঘোষণা হওয়ার সপ্তাহান্তে এসেও বিএনপি এসব বিষয়ে এখনো কিছু বলছে না। সরকার পতনের দাবিতে বিএনপি বর্তমানে একদফার আন্দোলন করছে। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিই তাদের অন্যতম আন্দোলন। এই দাবি আদায়

করতে হলে দলটিকে আরো আক্রমণাত্মক হতে হবে। হরতাল-জ¦ালাও-পোড়াওয়ের মতো কর্মসূচি দিতে হবে- যা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে যারা বাধা সৃষ্টি করবে- তাদের বিধিনিষেধের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে। সেক্ষেত্রে এমন আন্দোলন করলে যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে নির্বাচন প্রতিহত হয়েছে, তাহলে ভিসা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিএনপিকে অবশ্যই আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যেতে হবে। এর ফলে তাদের আন্দোলনও জমবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

অপরদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এই ভিসানীতিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে, নতুন ভিসানীতিতে সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার রাজনীতির সুযোগ রাখা হয়েছে। ভিসানীতিতে এটা প্রমাণ হয় না, যুক্তরাষ্ট্র সরকারবিরোধী কিংবা আওয়ামী লীগবিরোধী। বরং ঘোষিত ভিসানীতিটি যথেষ্ট ‘ব্যালেন্স’ অবস্থানে আছে। ওই নীতিতে বলা হয়নি, বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি না মানলে নির্বাচন হবে না। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনেই নির্বাচন হবে এবং এতে কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির খড়গ নামবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারও চায়, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ ভোট। পাশাপাশি রাজশাহীর বিএনপি নেতা চাঁদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার যে হুমকি দিয়েছেন তারও কড়া নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। এসব বিষয় আমলে নিয়ে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারবিরোধী নয়।

ভিসানীতি ঘোষণার পর শুধু ঢাকার সংবাদপত্রেই খবর প্রকাশ হয়নি, ভারতের সংবাদমাধ্যমেও তা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ হয়েছে। দেশটির পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফকে দেয়া মন্তব্যে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কৃষ্ণান শ্রীনিবাসন মার্কিন সিদ্ধান্তকে হাস্যকর বলে অভিহিত করেছেন। তিনি গত দুটি নির্বাচনের সময় (বাংলাদেশে) ঢাকায় মার্কিন কার্যকলাপের কথা উল্লেখ করেছেন, যা প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন ভিসানীতিতে তা বলা হয়নি। বরং ব্লিংকেন এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টে তার সহকর্মীরা ব্যাখ্যা করেছেন, নতুন ভিসানীতি সব পক্ষের জন্য প্রযোজ্য হবে এবং একমাত্র মার্কিন স্বার্থ- গণতন্ত্রকে উন্নীত করা।

বাংলাদেশের একাধিক রাজনীতিক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের সময় (১৯৭১ সালের) পাকিস্তানের সমর্থনে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। তাদের সিনিয়র কূটনীতিকরা সব সময়ই বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছেন। এ রকম পরিস্থিতিতেও নতুন ভিসানীতি বিএনপিকে আপাতত সুবিধা দিতে পারছে না। অর্থাৎ দলটি আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনে বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না। ঠিক এই জায়গাতেই স্বস্তি পাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে নতুন ভিসানীতির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। আগামী জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরে যাওয়ার কথা। সেই সফরে নয়াদিল্লি ঢাকা-ওয়াশিংটন ‘টাগ অব ওয়ার’কে কীভাবে তুলে ধরবে সেটি পর্যবেক্ষণে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষণে এও জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়ে আসছে। এই দলটি আবার আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে এখনো তাদের অবস্থান প্রকাশ করেনি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি, কারণ গত দুটি নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। আমরা বিশ্বাস করি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না এবং আমরা আমাদের দাবিতে অটল থাকব। কিন্তু এই ভিসানীতির পরও কীভাবে দলটি তাদের অবস্থানে অটল থাকবে তার বিশ্লেষণ তিনি প্রকাশ করেননি।

পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে কাজ করা একজন অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশি কূটনীতিকের মতে, নতুন ভিসানীতি এবং আসন্ন নির্বাচনে এর কী প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটি দিয়ে আসলে কী অর্জন করতে চায় তা মূল্যায়ন করার আগে আমাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে, কারণ বিবৃতিটি (ভিসানীতি) খুব সংক্ষিপ্ত।

তবে এটা ঠিক, বিবৃতির একটি উদ্দেশ্য- বাংলাদেশের অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যকে সমর্থন করা। এই উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে একত্রিত হয়েছে- যা ভিসানীতিতে পুনরাবৃত্তি হয়েছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, এই নীতির অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করতে পারবে।

আশ্চর্যজনক বিষয়, ভিসানীতি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু একটি বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নীতিটি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সদস্যদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, মার্কিন সরকার কখনোই অন্য দেশের নির্বাচনে পক্ষ নেয় না।

এখানেই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকার স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ হওয়ায় নতুন ভিসানীতি ঢাকাকে ‘পীড়া দেবে না’, যা পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতেও প্রকাশ হয়েছিল। অর্থাৎ সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মার্কিন ঘোষণাকে দেখেছে। তবে, বাংলাদেশ আশা করে, এই ধরনের ভিসানীতি নির্বিচারে উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রয়োগ করা হবে না।

তবে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা মনে করেন, নানা ঘটনায় এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক ওয়াশিংটন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মতো বিরোধী শক্তিকে কাছে টেনে নিয়েছে। কিন্তু তাদের ঘোষিত ভিসানীতি ভালো করে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই নীতিতে বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচন নয়, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নির্বাচন হবে এবং এতে বাধা এলে শাস্তির খড়গ পড়বে।

দ্য টেলিগ্রাফের কাছে করা এক মন্তব্যে কলকাতার বিশ্লেষক অরিন্দম মুখোপাধ্যায় বলেছেন, নতুন ভিসানীতি মার্কিন চাপের কৌশল ছাড়া কিছুই নয়। এর প্রাথমিক কারণ হলো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধারাবাহিকভাবে বিএনপির লবিং। তার মতে, নতুন নিয়মের প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে আমি আরো কিছু মার্কিন পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করব।

এদিকে বাংলাদেশের কেউ কেউ ভাবছেন যে মার্কিন এই পদক্ষেপের পর অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো থেকেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেবে কিনা। তবে নতুন ভিসানীতি নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তার মতে, বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারে যে এটি বিএনপির মতো বিরোধী দলগুলোর লক্ষ্য, যারা নির্বাচনের আগে সহিংসতায় লিপ্ত হয় এবং নির্বাচন থেকে দূরে থাকার এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার অজুহাত তৈরি করে। নতুন ভিসানীতির কারণে এবার তারা একই খেলা খেলতে পারবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App