×

অর্থনীতি

খেলাপি ঋণ বাড়ছে যে কারণে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৩, ০৮:২২ এএম

খেলাপি ঋণ বাড়ছে যে কারণে

ছবি: সংগৃহীত

দুর্বল নজরদারি

ঋণ বিতরণে দুর্নীতি

৩ মাসে বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা 

ব্যাংকিং খাতকে বলা হয় একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তাই এ খাতকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা একান্ত জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মোটেও ভালো চলছে না। বিশেষ সুবিধা আর ছাড় দেয়ার পরও ‘অর্থনীতির গলার কাঁটা’ খেলাপি ঋণ যেন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এই সামান্য কমছে তো ফের বাড়ছে। আর এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাফিলতিকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। মূলত, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণকে দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অপরদিকে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। এ কারণেই ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে ঋণ। দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণই পরে খেলাপি হচ্ছে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ কঠোর হচ্ছে না। যেসব ব্যাংকার দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, খেলাপি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে খেলাপি আদায়ে অ্যাকশনে যেতে হবে বলে মত তাদের। পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ‘খেলাপি’ সমস্যা দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োগের কথাও বলছেন তারা।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা হলেও আএমএফের হিসাবে খেলাপি দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তমতে, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি হিসেবে দেখাতে হবে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নেতৃত্বকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিক নেতৃত্বের অভাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তিনি বলেন, খেলাপিদের বারবার ছাড় দিয়ে দিচ্ছে। যদিও এটা অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে। মূলত, ড. আতিউর রহমানের সময় থেকেই এ সংস্কৃতির সৃষ্টি। সে সময়ের একটি বৃহৎ অংশ এখনো খেলাপি হয়ে আছে।

তিনি আরো বলেন, যারা প্রতিনিয়ত খেলাপি হচ্ছে, তাদের কোনো শাস্তি না দিয়ে একটার পর একটা ছাড় দিচ্ছে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, করোনাকালীন সময়ে একটা খারাপ মুহূর্ত ছিল। সে সময় ছাড় দেয়া গেলেও এখনো তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ঠিক হয়নি। উন্নয়নশীল কোনো দেশে এমন ছাড় দেয়া হয় বলে আমার মনে হয় না। খেলাপি কমিয়ে আনার বিষয়ে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, মূল দায়িত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। ব্যাংকগুলো খেলাপি আদায়ে পিছিয়ে থাকলেও তাদের কোনো শাস্তি হয় না। ব্যাংকগুলোর সুশাসন এক্ষেত্রে খুবই জরুরি। তিনি আরো বলেন, এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেখতে হবে কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে? ঋণ আদায় হচ্ছে না কেন? সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ঋণ আদায়ে নানা ছাড় দেয়া হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী বছরেও নানাভাবে ছাড় দেয়া হয়। বছরের শেষ দিকে এসে এক ব্যাংকের আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ অন্য ব্যাংক কিনে নিয়ে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। আবার ঋণ অবলোপনেও ছাড় দেয়া হয়। আগে যেখানে আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা করতে বাধ্য করা হতো। কিন্তু এখন মামলা ছাড়াই আদায় অযোগ্য একটি নির্ধারিত অঙ্কের খেলাপি ঋণ অবলোপনের সুযোগ দেয়া হয়। এর ফলে এসব ঋণ মামলা না করেই অবলোপন করা হয়। আর খেলাপি ঋণের হিসাবে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ দেখানো হয় না। আলাদা হিসাবে রাখা হয়। সবমিলেই খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ার কথা সেই হারে বাড়ছে না। অর্থাৎ প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রদর্শিত হচ্ছে না।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের জন্য যখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমার কথা, তখন উল্টো খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রথম রিভিউ করতে আসা সংস্থাটির কর্মকর্তারা। ২০২০ সাল থেকে খেলাপি ঋণের হার বাড়ার চিত্র দেখে আইএমএফ কর্মকর্তারা জানতে চেয়েছেন, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে খেলাপি ঋণ কমবে কীভাবে। আইএমএফ কর্মকর্তাদের এ প্রশ্নের জবাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলেছে, টার্গেট অর্জন করা যাতে কঠিন হয়, সেজন্যই সব সময় টার্গেট বেশি রাখা হয়। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আগামীতে টার্গেট আরো বাড়ানো হবে এবং আদায় বাড়িয়ে খেলাপির পরিমাণ কমানো হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের (২০২২) একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। আর তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। সবশেষ ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা।

চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫৭ হাজার ৯৫৮ টাকা। বেসরকারি ব্যাংক ১১ লাখ ৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংক ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বিতরণ করেছে এর মধ্যে খেলাপি ৪ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংক ৬২ হাজার ২৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে তাদের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা।

খেলাপি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণকে দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োগ করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের আরো ভূমিকা পালন করতে হবে।

আইএমএফকে দেয়া প্রতিশ্রæতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকের নন-পারফর্মিং লোন ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হচ্ছে, যেখানে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য আগামী জুনের মধ্যে একটি পলিসি নোট তৈরি করবে বাংলাদেশ। আইএমএফ ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা বাড়ানোর ওপরও জোর দিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App