×

জাতীয়

সীমাহীন দুর্নীতি উপকূল লাইটহাউস প্রকল্পে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৩, ০৯:৩০ এএম

সীমাহীন দুর্নীতি উপকূল লাইটহাউস প্রকল্পে

ফাইল ছবি

নৌ অধিদপ্তরের নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদন

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের লাইটহাউস প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস এন্ড সেফটি সিস্টেম এন্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ শীর্ষক প্রকল্পে একজন দোভাষীকেই এক বছরে পরিশোধ করা হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ টাকা।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার সামিহ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের দোভাষী মো. জসিম শেখকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩ জুন প্রকল্পের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত থেকে এই টাকা দেয়া হয়। নিরীক্ষাকালে এ প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক অসঙ্গতি ধরা পড়ে। অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামে ভৌতিক বেতন-ভাতা দেয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে।

অনিয়মের তদন্তে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দপ্তর এবং নৌ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা মেলেনি। এমনকি, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের মৌখিক নির্দেশনা সত্ত্বেও তার দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করেননি। অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

জানা গেছে, দেশের উপকূল এলাকা থেকে গভীর সমুদ্রের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ৭টি লাইটহাউস ও ৭টি কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় একটি ১১তলা ভবন নির্মাণকাজও রয়েছে। প্রকল্পটির সর্বশেষ বর্ধিত ব্যয় ৭৭৯ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়নে ধীরগতিসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তা খতিয়ে দেখতে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (সদ্যবিদায়ী) কমডোর নিজামুল হক গত ১০ এপ্রিল ৪ সদস্যের একটি ‘অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি’ গঠন করেন। অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক পরিচালক ও সরকারের উপসচিব বদরুল হাসান লিটনের নেতৃত্বে গঠিত নিরীক্ষা কমিটি গত ২১ এপ্রিল মহাপরিচালকের দপ্তরে দাখিলকৃত প্রতিবেদনেও নানান অভিযোগ, অসহযোগিতার চিত্র উঠে এসেছে।

নিরীক্ষা কমিটি নৌ মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দপ্তর থেকে এ প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পর্যন্ত ১৭ কোটি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে অনাবাসিক ভবন খাতে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি ৫১ লাখ ৬৯ হাজার ১০০ টাকা। এ টাকার মধ্যে সামি কনস্ট্রাকশন দুটি বিলে যথাক্রমে ৩ কোটি ১১ লাখ ৪২ হাজার ৮০২ এবং ২ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু কাজ সম্পন্নের ফিল্ডবুকের (সাইটবুক) কপি কমিটিকে দেয়া হয়নি।

অবশিষ্ট টাকা দেয়া হয়েছে সিডিডিএল এবং স্পিডি গ্রুপ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রকল্পের টাকা থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত আনোয়ার শিকদার ও মো. আনছার আলী নামে দুজন গাড়িচালকের নামে বেতন বিল উত্তোলন হচ্ছে। তবে বাস্তবে মো. আনছার আলী নামে কোনো চালকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ১৯ মার্চ অনাবাসিক ভবন খাত হতে স্পিডি গ্রুপকে পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯১ টাকা। এসব টেন্ডার ইজিপিতে করার কথা থাকলেও বিলে তা উল্লেখ করা হয়নি। আজকের প্রভাত ও দ্য ডেইলি আর্থ নামের দুটি অখ্যাত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় এ সংক্রান্ত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে এন্ড ডিজাইনের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে নকশায় নৌ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেয়া হয়নি। এছাড়া বেট্স কনসাল্ট্যান্টকে নিয়োগের ক্ষেত্রে পিপিআর-২০০৮ এর ১১০ ধারার ১-৬ উপধারা মানা হয়নি।

অধিদপ্তরের নিরীক্ষা কমিটি নৌ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার মাধ্যমে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে দোভাষীর বিল ছাড়াও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবু সাঈদ মো. দেলোয়ার রহমান নিজেই গত বছরের ৩ এপ্রিল প্রশাসনিক ব্যয় খাত থেকে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৪০ টাকা নিয়েছেন। তবে এসব ব্যয় প্রকল্পের ক্যাশ রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ নেই। এর ফলে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত নীতিমালা (পিপিআর)-২০০৮ এর ৫ ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে।

২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের সব বিল পাওয়া না গেলেও অপর্যাপ্ত বিলগুলো পর্যালোচনা করে অনেক অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। বিলগুলো পিপিআর-২০০৮, সরকারি আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রসহ সরকারি বিধিবিধান সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত থেকে মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও জুমাইমাহ ইন্টরন্যাশনাল (জেভি) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে ৫ কোটি ১৩ লাখ ১৯ হাজার ২৭৭ টাকা।

গত বছরের ১৫ জুন মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট এই টাকা নেয়। তবে নৌ মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কার্যালয় এই বিলটি নিরীক্ষা কমিটিকে দেয়নি। এমনকি, কাজ সম্পন্ন হওয়ার মেজারমেন্ট বুকও পায়নি নিরীক্ষা কমিটি।

বিশেষজ্ঞসহ নৌপরিবহন সংশ্লিষ্টরা এসব ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন। পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, একটি ছোট প্রকল্পে বাংলাদেশি একজন দোভাষীর মাসিক বেতন ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫০ টাকা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুধু কালক্ষেপণই হচ্ছে না, প্রতিটি পর্যায়ে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির স্বার্থে পিডি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সহঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App