×

স্বাস্থ্য

সরকারি হাসপাতালে রোগীদের দুর্ভোগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৩, ০৯:৫৪ এএম

সরকারি হাসপাতালে রোগীদের দুর্ভোগ

ছবি: সংগৃহীত

শত সীমাবদ্ধতায়ও শেষ ভরসা
গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মঙ্গলবার দাউদকান্দি থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আনা হয় রুবিনা বেগমকে (৩৫)। হাসপাতালে বেড পাননি। মাদুর বিছিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় রুবিনাকে নিয়ে আছেন বড় বোন জাহানারা বেগম (৫৫)। জাহানারা বলেন, আমার বোন পেটের সমস্যা নিয়ে প্রায়ই অসুস্থ থাকত। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু বোনের কী সমস্যা তা জানা যাচ্ছে না। ঢাকায় বড় বড় ডাক্তার। আর এই হাসপাতালে সব রোগের চিকিৎসা হয়; তাই এখানে নিয়ে এসেছি। বুকে টিউমারের চিকিৎসা নিতে গাজীপুর থেকে বুধবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন ইয়াকুব আলী (৬৫)। সকালে গাজীপুর থেকে এসে টিকিট কেটে বহির্বিভাগের সামনে সিরিয়ালের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন ইয়াকুব আলীর ছেলে ইয়াসিন আলী (২৭)। এক্সরেসহ বিভিন্ন রিপোর্টের কাগজ ব্যাগে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, সকাল ১০টায় লাইনে দাঁড়িয়েছি। সরকারি হাসপাতাল। কত মানুষ। কত লম্বা সিরিয়াল। কখন আমার সিরিয়াল আসবে কে জানে। সরকারি হাসপাতালে সেবা ভালো। তাই এখানে আসা। হৃদরোগ হাসপাতালে বেড না পেয়ে দোতলার ২ ও ৩ নম্বর লিফটের সামনে মাদুর পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন জামালউদ্দিন (৫৭)। তার মেয়ের জামাই মিন্নাত আলী বলেন, ডাক্তার বলেছে রিং পরাতে হবে। এখনো সিরিয়াল পাইনি। বেড না পেয়ে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। সমস্যা হলেও এখানে চিকিৎসাটা তো ভালো পাব। গালে টিউমার অপারেশনের পর রেডিওথেরাপি নিতে মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ল²ীপুর থেকে এসেছিলেন হারাধন দে (৭৭)। থেরাপির সিরিয়াল পেতে ইতোমধ্যে তাকে হাসপাতালে আসতে হয়েছে আরো একবার। কিন্তু সিরিয়াল পাননি। সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতিদিনকার চিত্র এমনই। প্রতিদিন সকালে হাসপাতালের বহির্বিভাগের টিকেট কাউন্টারের সামনে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। জরুরি বিভাগে রোগীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত হুইল চেয়ার ও ট্রলির ব্যবস্থা। কর্তব্যরত চিকিৎসক ঠিকমতো রোগী দেখেন না। বেড না পেয়ে অসংখ্য রোগী হাসপাতালের বারান্দায় মাদুর পেতে চিকিৎসা নেন শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়। টাকা ছাড়া মেলে না বিছানার চাদর-বালিশ। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট। হাসপাতাল থেকে ওষুধ দেয়ার কথা থাকলেও তা মেলে না। কোথাও ছারপোকা ও তেলাপোকার উপদ্রব। দালালদের দৌরাত্ম্য। যন্ত্রপাতি নষ্ট। চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের ব্যবহার এবং খাবারের মান নিয়েও অসন্তোষ। উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক না থাকায় ওয়ার্ডবয় বা সুইপার চিকিৎসা দেন। এমন অজ¯্র অভিযোগ দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে। এত অভিযোগের পরও অসুস্থ হলে সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা সরকারি হাসপাতাল। স্বল্প খরচে চিকিৎসার আশায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই এসব হাসপাতালে ভিড় করেন রোগীরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচের শতকরা ৯৫ ভাগ বহন করে সরকার। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে খরচ হয় ১০ টাকা এবং ভর্তি হতে লাগে ১৫ টাকা। হাসপাতালের ৭০ শতাংশ বেড বিনামূল্যে এবং ৩০ শতাংশ নামমাত্র মূল্যে পাওয়া যায়। এছাড়া ডায়াগনসিস খরচও কম। বিনামূল্যে ভর্তি রোগীদের দেয়া হয় খাবারও। এ কারণেই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের অন্যতম ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব হাসপাতাল। দেশের সরকারি হাসপাতালে দৈনিক অন্তত ১০ লাখ এবং বছরে ২৪ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মন্ত্রী আরো জানান, সরকারের এই বিনামূল্যে চিকিৎসার অর্থ গড় হিসাব করলে বছরে হয় ১২ বিলিয়ন ডলার। তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের এক হাজার লোকের বিপরীতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বেড রয়েছে একটিরও কম। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে কমপক্ষে ৩ দশমিক ৫টি বেড থাকা উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোর মতো নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা না থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলো নামমাত্র মূল্যে সেবা দিয়ে চলেছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী, প্রয়োজনের তুলনায় অল্পসংখ্যক চিকিৎসক ও সহকারী সেবাদায়ক, সীমাবদ্ধ বাজেট, প্রভাবশালীদের চাপ- সব চ্যালেঞ্জ কাঁধে নিয়ে রোগীদের সাধ্যমতো স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলো। রোগীর চাপ বাড়লেও সে অনুযায়ী হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়েনি। বাংলাদেশে বর্তমানে মধ্যবয়সি জনসংখ্যা বেশি। মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে। ফলে আগামীতে বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা বাড়বে। এতে ভবিষ্যতে হাসপাতালে সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়বে। আরো বেশিসংখ্যক মানুষকে সুষ্ঠুভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয়ার লক্ষ্যে দেশের প্রধান ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ১০ হাজার বেড বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ৫ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে ঢামেক হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এম এ জি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। প্রাথমিক পরিকল্পনা হিসেবে, ঢামেক হাসপাতাল বাদে অন্যান্য হাসপাতালে ন্যূনতম ৫শ থেকে সর্বোচ্চ ১৫শ নতুন বেড স্থাপন করা হবে। ঢামেক হাসপাতালে নতুন করে ২৪শ বেড যোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কারণ সারাদেশ থেকে রোগীরা ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। বেডের তুলনায় বাড়তি রোগীদের হাসপাতালের বারান্দাসহ বিভিন্ন খালি জায়গায় থাকতে হয়। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি প্রকল্প পরিকল্পনা তৈরি করবে। এতে নতুন বেড স্থাপনের জন্য ভবন তৈরি ও সংস্কার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বেড বাড়ানোর কাজ শুরু হবে আগামী অর্থবছরে। নতুন বেডের সঙ্গে অপারেশন থিয়েটার আধুনিকায়ন করা হবে। বাড়ানো হবে আইসিইউ বেডও। দেশে বর্তমানে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে ১৪ হাজার বেড রয়েছে। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে বেডের দেড় থেকে দুই গুণ অতিরিক্ত রোগী ভর্তি থাকে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও সারাদেশে অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে বেড রয়েছে ৫২ হাজার ৫৬০টি। শুধু মেডিকেল কলেজ নয়, উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের সেবার মান উন্নয়নেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ৯ মে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা বুঝে গেছি, উপজেলা পর্যায়ে সেবার মান না বাড়িয়ে দেশের মানুষের জন্য কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব। জেলা পর্যায়ের মতো করে উপজেলা পর্যায়েও আমরা বিশেষ নজর দিয়েছি। বেড সংখ্যা বাড়ানো, ডায়ালাইসিস বেড দেয়া, উপজেলা হাসপাতালেই অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন করার উদ্যোগ নেয়াসহ নানাবিধ কাজ করে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান দ্বিগুণ বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীরা যাতে আরো বেশি সেবা নেয়ার সুযোগ পায় এজন্য ডিউটি শেষে নিজ হাসপাতালেই চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুবিধা চালু করেছে সরকার। চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে নির্ধারিত কয়েকটি হাসপাতালে স্বল্প টাকায় রোগীরা এই চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন। সরকারের এই উদ্যোগ সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। তাই এই কার্যক্রমের পরিধি আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দেশের সর্ববৃহৎ সরকারি হাসপাতাল হিসেবে ঢামেক হাসপাতালেই রোগীর চাপ বেশি। এই হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ২৬শ। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকে ৩৮শ থেকে ৪ হাজার। ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগী এলে ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই তাদের। হাসপাতালে সব সময় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী থাকে। রয়েছে জনবল সংকট। রোগীর চাপ অনেক বেশি থাকায় নার্স ও চিকিৎসকদের কম্বিনেশন রোগীবান্ধব নয়। রোগীর দর্শনার্থীরাও সেবা ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে এসব হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাও কর্তৃপক্ষের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে। এতে রোগীদের বিভিন্ন রোগে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একই অবস্থা। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান, আগে থেকেই হাসপাতালের বেড বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকেও এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করেছে। তিনি বলেন, প্রতিটি হাসপাতালেই বেডের তুলনায় দ্বিগুণ বা এর চেয়েও বেশি রোগী ভর্তি থাকে। হাসপাতালগুলোতে নতুন বেড যুক্ত হলে রোগীদের দুর্ভোগ, সংক্রমণ ঝুঁকি কমবে। কাজের পরিবেশ উন্নত হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা দুই ধরনের- সরকারি ও বেসরকারি। সরকারি হাসপাতালে রোগীর প্রত্যাশা বেশি। সেখানে রোগীর চাপও বেশি। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী, প্রয়োজনের তুলনায় অল্পসংখ্যক চিকিৎসক ও সহকারী সেবাদায়ক। সীমাবদ্ধ বাজেট থাকায় রোগীরা যেমনটা প্রত্যাশা করেন তেমন সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। তবে এটিও ঠিক, সরকারি হাসপাতালে মানুষ অবহেলার শিকার হয়, হয়রানি হয় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App