×

সারাদেশ

গাজীপুর সিটি মেয়র পদে ছয় কারণে জায়েদার জয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৩, ০৯:০১ এএম

গাজীপুর সিটি মেয়র পদে ছয় কারণে জায়েদার জয়

ছবি: সংগৃহীত

ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের ‘প্রক্সি প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচনে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন সাধারণ গৃহবধূ জায়েদা খাতুন। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে হারিয়ে বহুল আলোচিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বর্ষীয়ান এই নারী। ক্ষমতাসীন দলের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েও আজমত উল্লার মতো শক্তিশালী একজন প্রার্থী গৃহিণী জায়েদার বিরুদ্ধে হেরে যাবেন, তা অনেকে ধারণাই করতে পারেননি। যে গৃহিণীর রাজনীতি তো দূরের কথা, কোনো দিন সভা-সমাবেশ কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানেও খুব একটা অংশ নেয়া হতো না- ছেলের রাজনীতির মারপ্যাঁচে অনভ্যস্ত সেই জায়েদাই ইতিহাস সৃষ্টি করে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পনগরীর মেয়র বনে গেলেন। বিষয়টি এখন দেশের টক অব দ্য কান্ট্রি। রাজনীতির মাঠে তার এই চমককে স্থানীয় সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করলেও এই জয়ের পেছনে সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীরের ভোট কৌশলকেই প্রধান কারণ হিসেবে মানছেন। কেউ কেউ জায়েদা খাতুনের এই সাফল্যকে ‘জাহাঙ্গীর ম্যাজিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করে ২০২১ সালে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হন জাহাঙ্গীর। আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার হন। চলতি বছরেই সাধারণ ক্ষমায় দলে ফেরেন। কিন্তু মেয়র পদে নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আবার আজীবনের জন্য বহিষ্কার হন আওয়ামী লীগ থেকে। কিন্তু ঋণখেলাপির কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়। ভোট করতে পারবেন না- এই আশঙ্কায় মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থী করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর। পুরো নির্বাচনী প্রচারে ছেলের ছায়া হয়েছিলেন জায়েদা। মা কাগজকলমে প্রার্থী হলেও বাস্তবে ভোটে লড়েছেন ছেলে। ফলে তার জয় আদতে জাহাঙ্গীরের বিজয় হিসেবে দেখছেন সবাই। আর এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে চৌকশ খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করলেন জাহাঙ্গীর। অবশ্য জায়েদার অসামান্য বিজয়ের পেছনে জাহাঙ্গীরের কুশলী ভোটচালের সঙ্গে আরো বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিএনপি-জামায়াতের ভোট, সহানুভূতি ও নারী ভোট, মেয়র থাকাকালে নগরীর উন্নয়নে জাহাঙ্গীরের আন্তরিক প্রয়াস অন্যতম।

বিএনপি-জামায়াতের ভোট ব্যাংক :

জায়েদার এই জয়ের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি কাজ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল, বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠীর নীরব সমর্থন। ভোটবর্জনের কারণে কোনো প্রার্থী না থাকায় বিএনপি-জামায়াতের একচেটিয়া ভোট পায় টেবিল ঘড়ি মার্কা। জাতীয় রাজনীতির অংশ হিসেবে বিএনপি থেকেও নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার সিগন্যাল ছিল। স্থানীয় কয়েকজন বিএনপিকর্মীর সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়। ভোটের দিন মাঠেই যার প্রতিফলন ঘটে। জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা বাতিল হলেও তার মাকে মেয়র পদে জয়ী করতে পুরো সিটিতে গোপনে কাজ করেছেন তারা।

জাহাঙ্গীরের নিজস্ব বলয় ও আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন :

এই নির্বাচনে নগরীর বেশির ভাগ কেন্দ্রেই টেবিল ঘড়ির পোস্টার ও এজেন্টদের দেখা না মিললেও নৌকার সরব উপস্থিতি এবং কোথাও কোথাও ভোট চলাকালীন কেন্দ্রের সামনে আজমত উল্লার সমর্থকদের মিছিলও করতে দেখা যায়। কিন্তু ভোটের ফলাফলে মেলে ভিন্ন চিত্র। নির্বাচনের দিন নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- দলের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীরকে আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুর মহানগরে রাজনীতি করা এবং মেয়রের পদে থাকায় রাজনীতির বাইরেও তার আলাদা একটা বলয় তৈরি হয়।

এছাড়া তিনি দলের বিশাল একটি অংশের গোপন সমর্থন পেয়েছিলেন। যেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্থানীয় কাউন্সিলর প্রার্থী, ৫৭টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে নির্বাচনী মাঠে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। দল থেকে বহিষ্কারের ভয়ে অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে থাকলেও ভোটের মাঠে কাজ করেছেন টেবিল ঘড়ির জন্য। নির্বাচনের দিন সরজমিন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে এর প্রমাণও পাওয়া যায়। অনেকেই নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ভোট চেয়েছেন জায়েদা খাতুনের টেবিল ঘড়ির জন্য। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অন্তত ২০ জনের আলাপ হয়।

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, নিরাপত্তার কারণে নৌকার পক্ষে থাকতে হবে তাদের। কিন্তু ভেতরে তারা টেবিল ঘড়ির জন্যই ভোট চাইছেন। বুকে নৌকা ব্যাজ লাগিয়ে এরকম কেন করা হচ্ছে- জানতে চাইলে সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীর একজন সমর্থক বলেন, আজমত উল্লার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আর আমাদের বিপদে-আপদে সব বিষয়ে আমরা জাহাঙ্গীর আলমকে কাছে পাই, তার সহযোগিতা পাই। তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন স্থানীয়ভাবেই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এখানে জাতীয় নির্বাচনের কোনো আঁচ নেই। ফলে এখানে যে আমাদের উন্নয়নে কাজ করবে, আমরা তাকেই বেছে নেব, এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া কথিত আছে, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার হাত আছে জাহাঙ্গীরের মাথার ওপর। এর বাইরে এবারের নির্বাচনে স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা একজন মন্ত্রীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তিনি যে কেন্দ্রে ভোট দেন, সেই কেন্দ্রেও নৌকা টেবিল ঘড়ির কাছে হেরে যায়।

স্থানীয় উন্নয়ন ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা :

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর ১০ বছর পার হয়েছে। তবে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন কিংবা সিটি করপোরেশনের তেমন কোনো সুবিধা পাননি নগরীর বাসিন্দারা। এর মধ্যেও প্রশস্ত মূল সড়ক ও অলিগলির প্রায় ৯০ ভাগ রাস্তাঘাটসহ যতটুকু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তা এই জাহাঙ্গীর আলমই করে দিয়েছেন বলে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক আলোচিত। এছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে তার রয়েছে নিবিড় সম্পৃক্ততা। যেমন- জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত বৃত্তি দেয়া, সিটির ৫৭টি ওয়ার্ডেই তার এই শিক্ষা ফাউন্ডেশনের শক্তিশালী কমিটি রয়েছে। দীর্ঘদিন এই কমিটির আওতায় উজ্জীবিত করেছেন স্কুল, কলেজে ও ভার্সিটি ছাত্রদের। এর মাধ্যমে এসব ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের সদস্যদের কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। নগরীর সব মসজিদের ইমামদের নিয়ে ইমাম সমিতি করেছেন। সেখানে প্রতি মসজিদের ইমামদের মাসে ৪০০০ করে বছরে ৪৮ হাজার টাকার এককালীন চেক তাদের হাতে তুলে দিতেন। এই ইমামদের পরিবারের কয়েক হাজার সদস্য তার ভক্ত। অনেক অসহায় ও বেকার পরিবারের সদস্যদের চাকরির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এছাড়া সব দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সুসম্পর্ক রাখতেন এবং তাদের বিপদে-আপদে পাশে ছিলেন। ব্যবসায় আয় করা অর্থের বেশির ভাগ অংশ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতেন। এলাকায় ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী ব্যক্তি হিসেবে ভালো ব্যবহার করায় সাধারণ মানুষ তার প্রতি অনুরক্ত।

ভাসমান ভোট :

এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, গাজীপুরে দলীয় নেতা কিংবা ব্যক্তি হিসেবেও আজমত উল্লা খানের চেয়ে জাহাঙ্গীর আলমের ভোট বেশি। গত কয়েকটি নির্বাচনে এটি বোঝা যায়। বিশেষ করে গাজীপুরে মোট ভোটারের প্রায় ৪০ শতাংশ হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভাসমান ভোটার। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এবং জাহাঙ্গীর আলম নিজেও একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলে এই ভাসমান ভোটারদের (পোশাক শ্রমিক) অধিকাংশই তাকে ভোট দেন। এটি গাজীপুরের একটি বিরাট ভোটব্যাংক। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, সেখানেও জাহাঙ্গীর আলম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং ভোটের দিনের বেশ কয়েকদিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পান। তার মানে ভোটের মাঠে থাকলে হয়তো তিনি ওই নির্বাচনেও জয়ী হতেন। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারকে বিপুল ভোটে হারিয়ে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হন।

সাধারণ মানুষের সহানুভূতি :

এই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর এবং তার মা সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পেয়েছেন। জাহাঙ্গীর আগেরবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার তিন বছরের মাথায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। জাহাঙ্গীরের অভিযোগ ছিল- বিনা কারণে তাকে ষড়যন্ত্র করে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তার ওপর অবিচার ও অন্যায় করা হয়েছে বলে তিনি ভোটারদের কাছে এর সপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং তিনি ব্যালটের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে এ অন্যায়ের বিচার দাবি করেন। স্থানীয়দেরও দাবি, একজন নির্বাচিত মেয়রকে কোনো কারণ ছাড়াই চেয়ার থেকে সরিয়ে দেয়া তারা মেনে নিতে পারেননি। এ বিষয়টি সাধারণ মানুষের মনে দাগ কেটেছে। এছাড়া জায়েদা খাতুন নারী হওয়ায় নারীদেরও সহানুভূতি পেয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জনসম্পৃক্তহীন আজমত উল্লা :

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা মার্জিত, বিনয়ী ও স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ হিসেবে গাজীপুরের রাজনীতিতে পরিচিত হলেও তার বিরুদ্ধে জনসম্পৃক্তহীনতার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের তৃণমূলের নবীন কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তার যোগাযোগের গ্যাপ রয়েছে। সেটি বয়সের কারণে হোক কিংবা তার ব্যাক্তিগত যোগাযোগের কারণে হোক। স্থানীয় মানুষের ভাষ্য- গাজীপুর মহানগরের মতো শিল্প এলাকার সরকারি দলের শীর্ষ নেতা হলেও তিনি মানুষের দুয়ারে পৌঁছাতে পারেননি। দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও সাধারণ মানুষের কাছে হতে পারেননি আস্থার প্রতীক। এছাড়া নির্বাচনের প্রচারেও ছিল গাফিলতি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে ঢিলেমি ছিল প্রচারণায়। বড় বড় শোডাউন এবং রোড শো করলেও মানুষের দ্বারে দ্বারে যাননি। এর ঠিক উল্টোপথে হেঁটেছিলেন জায়েদা খাতুন। ছেলে জাহাঙ্গীর আলমকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। বড় সভা-সমাবেশ এড়িয়ে ভোটারদের কাছে পৌঁছেছিলেন জায়েদা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App